ছায়াবৃতা।। সুনীল সেনশর্মা।।

পাহাড়ের কাছে এলে আমার মনের অতল থেকে একটা ভাব ওঠে। মনে হয় এ পাহাড়ে আমার পদচিহ্নই প্রথম পড়বে—মনে হয় অনেক গোপন রহস্য অপেক্ষা করছে আমার জন্য—যা আমিই প্রথম উদ্‌ঘাটন করব—মনে হয় এর গহন-কন্দরে যে গুপ্তধনের পাহারায় যক্ষের দল শত শত যুগ কাটিয়েছে—তারা যেন আমারই অপেক্ষায় রয়েছে—তাদের যুগ যুগ সঞ্চিত সে সম্পদ, সে ঐশ্বর্য আমার হাতে দেবার অপেক্ষায়—

ইয়াজালির ছোট্ট সবুজ একখানি গোলাকার উপত্যকায় দাঁড়িয়ে উত্তরে মালভূমির দিকে তাকিয়ে আমি সেই কথাই ভাবছিলাম। হাওয়া ক্যাম্প থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার উত্তরে ছোট্ট এই উপত্যকাটির গঠন—চ্যাপটা চায়ের ডিশের মতো। অর্ধবৃত্তাকারে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে চাষের জমিগুলি সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে উঠে গেছে। একদিক থেকে ছোট্ট পাহাড়ী নদী বয়ে চলেছে রাঙা নদীর দিকে—।

এখানে দেখলাম একদল ডাফলাকে, কোমরের ওপর থেকে জানু পর্যন্ত পাকে পাকে জড়ানো বেতের আবরণ—মাথার চুল উঁচু করে বাঁধা। আমার ক্যামেরার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ছবি তুলতে সাহায্য করল।

শুনেছি ঐ মালভূমির উপর সুবনসিঁড়ি ডিভিসনের হেডকোয়ার্টার শহর 'জিরো'। মালভূমির নাম হাপোলি। এই মালভূমি আপাথানীদের আবাসস্থল।

মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আমি এক আপাথানী দম্পতিকে দেখে এলাম। রাঙা নদীর আশেপাশে তখন কিছু কাজের জন্য ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই রাস্তার উপর উঠেছি সবে বন-বাদালি ভেদ করে। রাস্তায় ওঠার আগে পর্যন্ত দৃষ্টির আড়ালে ছিল সব। বুনো কলার জঙ্গলে পচা পাতা আর ভিজে মাটিতে ক্ষণে ক্ষণে পা বসে যাচ্ছে। এমনি স্যাঁতস্যাতে জমিতে রয়েছে অজস্র জোঁক—অনেক কসরৎ করেও ওদের আক্রমণ থেকে বাঁচা কঠিন। আর ছিল নেফার ডাম্‌ডিম্। ছোট্ট হলুদ রঙের সর্ষের আকারের এই ক্ষুদ্র মশকশ্রেণীর জীবটি অতি ভয়ঙ্কর। কখন যে গাত্রাবরণ ভেদ করে হুল ফুটিয়ে দেয় টের পাওয়া যায় না। তারপর শুরু হয় চুলকানি এবং অনর্গল রক্তক্ষরণ। রক্তক্ষরণ বন্ধ হবার পর মাংস যায় ফুলে—বেশ কিছুদিন যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় রেখে কালসিটে দাগ ফেলে শেষ হয় যন্ত্রণার। শুনেছি এদের দৌরাত্ম্যে হাতিও পাগল হয়ে যাবার উপক্রম হয়।

শারীরিক এই-সব যন্ত্রণা সয়ে রাস্তায় উঠে সবে বসেছি, হঠাৎ নজর পড়ল অদূরে এক পাহাড়ী দম্পতি আহারে রত। একটা অ্যালুমিনিয়মের থালা থেকে দলা পাকানো ভাতের সঙ্গে অদ্ভুত আকৃতির কী মেখে তুলে তুলে খাচ্ছে। খাওয়ায় হাতের চেটোর ব্যবহারই প্রকট। আমাদের মতো খাওয়ার সময় আঙুলের ব্যবহার দেখা গেল না। কিন্তু আমি অবাক হলাম রমণীটির মুখের দিকে তাকিয়ে। কী বীভৎস মুখের চেহারা! সমস্ত মুখময় উল্কি—চিবুক থেকে নীচের দিকে কালো কালো প্রলম্বিত রেখা। কানের ডগায় গভীর ছেদ এবং বেশ মোটা কাঠের কর্ণাভরণ। আমার অবাক লাগল এত বড়ো কর্ণাভরণ পরেও কী করে কানের পাতলা অংশ অক্ষত রয়েছে। আমি ক্যামেরা তুলতেই প্রচণ্ড রাগে গরগর্ করতে করতে ঘুরে বসল। আমার আর সাহস হলো না ঘুরে গিয়ে ছবি তোলার। এই ভয় আমার রয়েই গেল। যদিও পরে বেশ আলাপী এবং শান্ত-স্বভাবের পরিচয় পেয়েছি—জিরো মালভূমিতে—তবুও বোধ হয় এই ভয়েই কোনো সময় আমি ক্যামেরায় হাত দিতে সাহস করিনি।

আপাথানী মেয়েদের মুখ বিকৃতির গল্প শুনেছি। সুবনসিঁড়ির এই অংশের মালভূমি ছাড়া পাহাড়ের চূড়ায় বাস করে ডাফলারা। ডাফলারাই বোধ হয় নেফার পার্বত্যজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদিম বৃত্তিগুলো জিইয়ে রেখেছে। স্থায়ী চাষবাসের চেয়ে বনে-জঙ্গলে শিকার এবং ফলমূল আহরণ করেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রকৃতির অনুদার প্রতিকূলতার কাছে পরাভব মেনে নেওয়ার ফলেই বোধহয় ওদের সংখ্যাও ক্রমে ক্রমে ক্ষীণতর হয়ে আসে। পার্বত্য আদিম জাতির মধ্যে নিজেদের গোষ্ঠীসংখ্যা পরিবর্ধনের প্রয়াস সুবিদিত। কিন্তু তার পদ্ধতি ছিল অন্যরূপ। সুযোগ পেলেই ওরা অন্য গোষ্ঠীর নারী-পুরুষদের ধরে এনে নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ করত অনেকটা ক্রীতদাস প্রথার মতো। এটার লক্ষ্য কোনো কোনো সময় নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দিকেই থাকত। অপেক্ষাকৃত শান্তিপ্রিয় আপাথানীরা এদের অত্যাচারে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। রাতের অন্ধকারে, দিনের আলোয় পুরুষদের অনুপস্থিতির সুযোগে ডাফলারা দলে দলে আপাথানী মেয়েদের চুরি করে নিয়ে পালাত।

এমনি অবস্থায় আপাথানীদের কাবাঙে (পঞ্চায়েত) স্থির হলো—যে মুখের সৌন্দর্যে ডাফলারা ওদের মেয়েদের চুরি করে নিয়ে যায়—সেই মুখ উল্কি দিয়ে বিকৃত করে দেওয়া হবে। পৃথিবীর প্রায় প্রতি আদিম জাতির মতো এরাও জঙ্গলের লতাপাতা দিয়ে উল্কির জন্য উপযুক্ত স্থায়ী রঙ তৈরি করত। সেদিন থেকে নাকি আপাথানী মেয়েদের কৈশোর পেরোবার আগেই মুখে বিচিত্র রকমের উল্কি এঁকে দেওয়া হতো। এ ইতিহাসের শুরু হয়তো বহু যুগ পূর্বের। কিন্তু তার পর বৈরীভাব শেষ হবার পরও এই নিয়ম চলল। হয়তো আবাল্য এমনি দেখতে অভ্যস্ত আপাথানী মরদরা এটাকে সৌন্দর্যের মর্যাদা দিয়েছিলেন। মানুষের বিচিত্র সৌন্দর্যজ্ঞান! জোর করে পা ছোটো করাকেও তো চীন দেশের পুরুষ মেয়েদের সৌন্দর্য মনে করত।

.

.

.

ছায়াবৃতা

সুনীল সেনশর্মা

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা

সুপ্রকাশ 


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।