এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

একদেশ থেকে ছিন্নমূলেরা দলে দলে আসতে থাকল, এদেশের প্রান্তিকেরা পাড়াকে পাড়া উজাড় করে যে কোথায় গিয়ে পুনর্বাসন পেল, তার হদিস পেলাম না। যেদিন সন্ধ্যার সময়ের কথা প্রসঙ্গে এতসব কথা এল, সেদিন আমরা, মানে মা, টুনু (আমার স্ত্রী) এবং অন্য ছোটো ভাইবোনদের কেউ কেউ বারান্দায় বসে দেশের বাড়ির গল্প করছিলাম। হঠাৎ কয়েকটি কচি কন্ঠের ছড়া গান কানে এল। হ্যারিকেন হাতে কয়েকটি ছোটো ছোটো প্রায় আধা ন্যাংটা রোগা-ভোগা ছেলে-মেয়ে ছড়া গাইতে গাইতে উঠোনে এসে দাঁড়াল। তারা গাইছিল—

ঘেঁটু চাই ঘেঁটু চাই ঘোষপাড়া,
ঘেঁটু আমাদের প্রাণের ঠাকুর।
যে দেবে থালা থালা
তার হবে সোনার বালা।
যে দেবে ঘটি ঘটি
তার হবে সোনার বাটি।... ইত্যাদি।

একখানা ডালা না কুলোয় যেন কিছু ঘেঁটুফুল (ভাট ফুল), আশেপাশে এক-আধটা পয়সা বা সামান্য কয়েক মুঠো চাল। বাড়ির কিছুটা তফাতে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের বাড়ি। তাঁর বাড়ির পাশেই এই সব শিশুদের বাসস্থান, যার অধিকাংশই এই ভদ্রলোক দখল করে নিয়েছিলেন। এদেরটা তখনও পারেননি। সম্ভবত এদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা জোটেনি। অথবা তাদের এই পাড়া ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছে ছিল না। আমাদের প্রতিবেশী সেই ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক প্রায়শই আমাদের বাড়িতে আসেন। সেদিনও, ঠিক এই সময়টাতেই তিনি এলেন। বাচ্চাগুলোকে আমাদের বাড়ির উঠোনে দেখে, তিনি প্রায় মারমুখো হয়ে তাদের তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মা ছোটো বোনকে বললেন—'ওদের এক বাটি চাল দিয়ে দে।' ব্রাহ্মণ বললেন—'ওরা দুলে পাড়ার, ওদের আমরা ছুঁই না। ছোটো জাত, জল-অচল। ওগুলো ছোটো ছেটো ছেলেমেয়ে হলে কী হবে, সব কটাই চোর, আমরা ওদের ছায়াও মাড়াই না। ওদের ছায়া মাড়ানোও পাপ।' আমি জানতাম এই ব্রাহ্মণই লোভ দেখিয়ে এদের জমিজমা ভিটেবাড়ি নামমাত্র মূল্যে দখল করে এদের তাড়িয়েছেন।' আমি বললাম—'এদের জমি জায়গা ছুঁলে পাপ হয় না?' ভদ্রলোক (?) আমার কথায় অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলেন।

বাচ্চাগুলোর মুখ দেখে কষ্ট হচ্ছিল। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমরা বললাম—'তোরা আরও কিছু গান শোনা, আমরা শুনবো।' একটি ছেলে বলল—'গাইব? কিন্তু চার আনা পয়সা দিতে হবে। কাল আমাদের ঘেঁটু পুজো। আজকে 'ভিখ' খুব কম পেয়েছি। বললাম—'দেব। ছড়া বল।' প্রবল উৎসাহে তারা ছড়া গাইল। এই উৎসবটা দেশে থাকতে কোনোদিন দেখিনি। ভদ্রেশ্বরের বা হুগলি জেলার পল্লী অঞ্চল ঘুরে দেখা হয়নি। ভাবলাম, এই অঞ্চলের লোকায়তিক এই জাতীয় উৎসব নিয়ে কিছু খোঁজ খবর করতে হবে।

এরপর থেকে কিছু কাল আমি হুগলি জেলার বিভিন্ন পল্লী অঞ্চলে ঘোরাঘুরি শুরু করেছিলাম। কিন্তু ঘাড়ের উপর তখন চাকরি এবং পরিবার-প্রতিপালন এমন চেপে বসেছিল যে সামান্য ঘোরাঘুরিরও সময় পেতাম না। তার ওপর তখন আবার সমাজ বিপ্লবেরও 'বাই' মাথায় চেপে বসেছিল। তখনও লেখালেখির জগতে প্রবেশ করিনি। সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, বিষাদবৃক্ষ যখন লিখেছি, তখন যে স্মৃতিশক্তি ছিল, এখন আর তা নেই। বয়সের কারণে, বাল্যস্মৃতিসমূহের মধ্যে একটা বিরাট ওলোট-পালট হয়ে গেছে এবং ক্রমাগত হয়ে চলেছে। আমার বাল্যকালীন, পূর্ববঙ্গীয় স্মৃতি লেখালেখির জগতে যতটা স্বাভাবিক স্ফূর্ততায় এসেছে, এখন আর সেই সহজতা নেই। সব স্মৃতিই ছেঁড়া-কাটা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আসলে গ্রামীণ জীবনের সেই অঙ্কুরিত হওয়ার কালে জীবনের ক্রমবিকাশমান রহস্যময় অনুভূতিটা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই যেন বিলুপ্তির পথ ধরেছে। অনেক কিছুই এখন আর শারীর-মানস শিহরণ ঘটায় না। ফলে একদার লোকায়তিক সাংস্কৃতিক মুগ্ধতা লেখার মধ্যে সহজ থাকে না।

সেদিন দুলে-বাগদির বাচ্চাদের- 'ঘেঁটু চাই ঘেঁটু চাই ঘোষপাড়া' ইত্যাদি ছড়াগান শুনে, মনটা চলে গিয়েছিল বিষাদবৃক্ষে বর্ণিত মাঘমণ্ডলের ব্রতের অনুভূতিতে। কিন্তু, সেই অনুভূতিকে পূর্ণ-মর্যাদায় ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
.
.
.
এপার বড়ো মাঘ মাস, ওপার বড়ো কুয়া
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী 

মুদ্রিত মূল্য : ২৭০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।