বাঙালির শিকার স্মৃতি।। সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস।।

জঙ্গলের ডাকবাংলোয় রাত্রি প্রায় ন'টার সময় দরজা ধাক্কানো শুনে ঠাকুমার ঝুলির রূপকথার সেই কথাটা মনে এল, এত রাত্রে কে ডাকাডাকি করে?

কিন্তু প্রথম ধাক্কায় আমি সাড়া দিই নি। পর পর দু'রাত জেগে শিকারে গিয়ে শরীর ক্লান্ত, কাজেই তৃতীয় রাত্রি পুরো বিশ্রাম নেব ঠিক করেছি। স্থানীয় শিকার-সঙ্গী রফি এসেছিল হাঁকোয়ার প্ল্যান করতে, আমি তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সাড়ে আটটার মধ্যে নৈশভোজন শেষ করে লেপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। একে শীতকাল, তার ওপর দু'রাত্রি ঘুম নেই, কাজেই বিছানায় গা-টা এলিয়ে দিতে সারা শরীরে একটা আরামের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। শিয়রে রাখা হ্যারিকেনের মৃদু আলোতে রিডার্স ডাইজেস্টের একটা গল্প পড়ছি, আর নিদ্রাদেবীর আরাধনা করছি। তখন কি আর কেউ ডাকলে উঠতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভগবান বিরূপ, দরজায় আর একবার ধাক্কা পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে ডাক, 'শিকারী সাহেব হো।'

বিরক্ত হলাম, কিন্তু উঠতেই হল। দরজা খুলে দেখি বারান্দায় দু'টো লোক। একজন বেশ লম্বা, আর একজন বেঁটে। তাদের হাতে হ্যারিকেন, গায়ে পুরোনো কোট, আর তার ওপর নাক আর চোখ দু'টো খোলা রেখে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত চাদর জড়ানো। আমাকে দেখে লম্বা লোকটি হ্যারিকেনটা নিজের মুখের কাছ পর্যন্ত তুলে, ঠোঁটের ওপর থেকে চাদরটা নামিয়ে বলল যে, সে ক্ষত্রিয়, নাম রাম সিং, এখানকার দোকানগুলোতে সে দুধ বিক্রী করে। লোকের মুখে আমরা কথা শুনে সে এসেছে। তার পাকা ধানের ক্ষেত রোজ রাত্রে একদল শুয়োর এসে তচনচ করে দিয়ে যাচ্ছে। এখন আমি যদি দয়া করি, তবে তার ফসল বাঁচে, আর আমার শিকারও হয়।

আমার বিরক্ত ভাব কাটে নি, বললাম, 'তোমরা তাদের তাড়িয়ে দাও না কেন?'

'হুজৌর', রামসিং বলল, 'সে শুয়োর এক-একটা মোষের বাচ্চার মতো। সেদিন রাত্রে আমরা তাড়িয়ে দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি শুয়োর আমাকেই তাড়া করল। মেরেই ফেলত আমাকে, নেহাৎ কাছাকাছি একটা খেজুরগাছ পেলাম, তাতে উঠেই জান বাঁচিয়েছি। সে কথা মনে করলে এখনও ভয়ে কাঁপতে থাকি।'

এখন সমস্যায় পড়লাম। একদিকে অত বড় শুয়োর, অন্যদিকে আরামের বিছানা। কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখি নিজে ঠিক না করতে পেরে, রামসিংকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'রফিসাহেবকে চেন?'

'খুব চিনি', সে ঘাড় হেলিয়ে বলল।

বললাম, 'তাকে গিয়ে ধর। সে যদি যায় তবেই আমি যাব।'

রামসিং তার অনুচরকে নিয়ে প্রস্থান করল। আমিও বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম আবার। ভাবলাম, রফি এই শীতে আর যাচ্ছে না, কাজেই আজ রাত্রে ঘুম দিতেই হবে। কিন্তু পনের মিনিট কাটল না দেখি ওরা রফিকে এনে হাজির। রফি ঘরে ঢুকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, 'আজও আপনার বরাতে ঘুম নেই।'

রফির কথায় ও হাসিতে আমার ঘুম আর বিরক্তি দুই-ই উবে গেল। সে তার শিকারী বেশে, কাঁধে একনলা বন্দুকটা ঝুলিয়ে প্রস্তুত।

আমি চেয়ারগুলো এগিয়ে দিয়ে রফিকে জিজ্ঞসা করলাম, 'ব্যাপারটা কি, সত্যি শুয়োর আসে তো?'

রফিকে উত্তর দিতে হল না, রামসিং বলল, 'হুজৌর, আপনি চলুন, দেখবেন ওরা ঠিক রাত্রি বারোটার সময় আসবে। রোজ তারা ঐ সময়েই আসে।'

একথা শুনে রফির দিকে চাইতে, রফিও বলল, 'ওদিকটায় শুয়োর খুব আছে। যদি চান, চলুন, শুয়োর পেয়ে যাবেন ঠিক।'

ব্যাপারটাকে আর উপেক্ষা করা গেল না। আমি খানসামাকে ডেকে কফি তৈরী করতে বলে নিজের পোশাক পাল্টাতে শুরু করলাম। তারপর কফি খেয়ে রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ, রফি আর রামসিং-এর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। রামসিং তার অনুচরকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল ক্ষেতের পাশে কুড়হায় বসবার জায়গা ও আগুন ঠিক করে রাখবার জন্য।

পথ কম করার জন্য রামসিং কিছুটা রাস্তা বরাবর গিয়েই মাঠে নেমে পড়ল। ওঃ, লাঙলচষা সে যে কী মাঠ, আর তার ওপর দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি। যাই হোক, রফির সাহায্যে, অনেক কসরৎ করে রাত্রি প্রায় পৌনে এগারোটার সময় আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম বিঘে পাঁচ-ছয় করে পাশাপাশি দুটো ধানের ক্ষেত, আর তাদের মাঝখানে ফুট-তিনেক চওড়া একটা আল। সেই আলের ওপর ছোট্ট কুড়হার মধ্যে খড় বিছিয়ে আমার বসবার জায়গা হয়েছে, আর তার সামনেই ছোট্ট একটু আগুন করা। কুড়হার মধ্যে সেই বেঁটে লোকটা বসেছিল। আমরা যেতেই সে উঠে পড়ল। রফি তাকে নিয়ে ক্ষেতের অন্য কোণে চলে গেল। রামসিং আর আমি রয়ে গেলাম এই কুড়হাতেই। সেখানে আমি প্রথমেই আগুনটা নিবিয়ে ফেললাম, আর ধোঁয়াভর্তি কাঠগুলো ধানের ক্ষেতের জলে গুঁজে দিলাম। মাঝে মাঝে হাত গরম করে নেবার জন্য ছাইচাপা দিয়ে অল্প একটু আগুন রেখে দিলাম। তারপর কুড়হার দেওয়ালে রাইফেলটা ঠেসান দিয়ে রেখে, যতটা সম্ভব শরীরটাকে কুড়হার ভেতরে রেখে বসে পড়লাম। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত শান্ত রাত। আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে মাঠের ওপর। শব্দহীন, সাড়াহীন অচেনা এক মায়াবী জগৎ যেন এই শীতের রাতে ঘুম ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। 
.
.
.
রামসিংহের সাহস
জগমোহন মুখোপাধ্যায়
....................................
বাঙালির শিকার স্মৃতি
সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা 

সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।