কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

সব কিছু ঠিকঠাক মিটে গেছে। এমনকী চল্লিশ দিনের কাজও হয়ে গেল। কোথাও কিছু অনিয়ম হয়নি। যাদবের আত্মার শান্তির জন্য গির্জায় মীসা বা যজ্ঞ উৎসর্গ করা হয়েছে। রেবেকার ইচ্ছানুসারে দুপুরে প্রার্থনা সভায় যোগদানকারীদের মাংস-ভাতও খাওয়ানো হয়েছে। রাফায়েল নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছে। যারা কবর দিতে গিয়েছিল, বাড়িতে এসে শেষ দেখা করে গিয়েছে, তা ছাড়াও যারা আসতে পারেনি, তাদের দু-চারজনকেও বলা হয়েছিল। গির্জার পালক পুরোহিত মানে বড় ফাদার চল্লিশ দিনের উপাসনা করেন। মহিলা সমিতির মায়েরা গান প্রার্থনা করে। স্মৃতিচারণও করল কেউ কেউ। রাফায়েলকে বলতে বলা হয়েছিল, বলতে পারল কোথায়? দু-চার কথা বলার পরেই তো সে কেঁদে ফেলল। হয় না, পারা যায় না। যতই হাঁড়ি ভিন্ন করে নিক না কেন, সে তো মায়ের পেটের ভাই।

খরচও হলো বিস্তর। সবটাই রাফায়েলকে সামলাতে হয়েছে। জমানো টাকার অনেকটাই খরচ হয়ে গেল। সে হাসে নিজের মনে। খরচ! টাকা জমানো! জমাতে হয়, তাই জমায়। সে মরে গেলে কে নেবে টাকা পয়সা? কে ভোগ করবে এই ঘরবাড়ি?

নতুন চিন্তা ছেয়ে গেল তার মাথায়। সত্যিই তো, এতদিন ভাবেনি, আর তো কেউ রইল না, এই একরত্তি মেয়েটা ছাড়া। ওর লেখাপড়া আছে। রেবেকারও খরচ-খরচা আছে। এখনও তো পাঁচিল দাঁড়িয়ে আছে দুই পরিবারের মধ্যে। পরিবার? বরং বলা ভাল দুই ভাইয়ের মধ্যে। যাদবের পারলৌকিক কাজের ভার সব কাঁধে তুলে নিয়েও পাঁচিলটাকে তো সে অস্বীকার করতে পারছে না। যদিও কোনও দলিল হয়নি। খামোকা মনান্তর করে গোঁ ধরে পাঁচিল তুলে দিয়েছিল। রাফায়েলও মেনে নিয়েছিল নিশ্চুপে। কিন্তু এখন? যাদব তো সব ফেলে পালিয়ে গেল। এখন তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটাই ভরসা। ক-টাকা আর পাবে, তাই দিয়ে কি চলবে রেবেকার? রাফায়েল বুঝতে পারে তার হালকা কাঁধ দুটো যেন ভারি হয়ে আসছে।

রাফায়েল শুনতে পেল দরজায় কে যেন কড়া নাড়াচ্ছে। বেশ জোরেই নাড়ছে। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হলো সে। কদিন কোনও কাজ করছে না। ভাইয়ের জন্যেই বন্ধ রেখেছিল। ভাবছিল, মনটাকে গুছিয়ে নিয়ে আবার কাজ শুরু করবে। হাতে একটা বোর্ড আছে। ওটা শেষ করতে হবে। খাবার মহলও ভেঙে নতুন হচ্ছে। তার ভিতটা সাজিয়ে দিতে হবে, রঙ করতে হবে। অনেক টাকার কাজ।

কড়া নেড়েই যাচ্ছে।

কিছুটা বিরক্ত হয়েই পা চালিয়ে দরজার হুড়কো আর ছিটকানি খুলল।

—কে রে? বলে দরজা খুলতেই দেখে যাদবের মেয়ে, রুমকি।

অবাক হয়ে গেল রাফায়েল। মনে হলো কদিন আগেও যে মেয়েটা মায়ের রাতদিন বকুনি আর মার খেতো, সে যেন এই একমাসেই বড় হয়ে গেছে।

রাফায়েল একগাল হেসে বলল, কী রে তুই?

রুমকি জিজ্ঞাসা করল, তুমি ঘুমাচ্ছিলে?

—না তো।

—মা কতবার ডাকল, তুমি শোনোনি?

—না তো। কেন?

—মা তোমাকে ডাকছে। এক্ষুণি যেতে বলল।

—চল যাচ্ছি।

—না, এক্ষুণি চলো। বলে সে রাফায়েলের একটা হাত ধরল।

রাফায়েল চেয়ে রইল রুমকির দিকে। যাদবের মেয়ে, মানে তো ওদেরই তো বংশধর। নিরু বিশ্বাসের নাতনি। তার ভাইঝি। অনাথ হয়ে গেল মেয়েটা। নাহ, যাদব নেই তো কী, সে তো আছে। রুমকি যাদবের মেয়ে তো তারই মেয়ে। সে বাপের আদর দিয়ে তাকে বড় করতে পারবে না? সংসার না করলেও সংসারের দায়-দায়িত্ব ঈশ্বরই তো তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।
.
.
কীর্তনীয়া
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।