কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

—মাসি, ঘরে আছো নাকি?

নারীকণ্ঠে ডাক শুনেই চোখ মেলল রাফায়েল। দেখল এক যুবতী উঠোনে দাঁড়িয়ে। বয়স মনে হচ্ছে ছাব্বিশ-সাতাশের এপার-ওপারে। মেদহীন হালকা শরীর। লালপাড় বাসন্তী রঙা শাড়ি পরে আছে। গলায় কণ্ঠী। কপালে তিলকের কিছুটা অংশ বোঝা যাচ্ছে, বাকিটা জল আর কাপড়ের ঘষায় উঠে গেছে।

ডাক শুনে বোষ্টমী ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তামাক ঘষা দাঁতে হাসি ছড়িয়ে বলল, আরে তুলসি, কবে এলি!

—কাল রাতে মাসি। তিন-চারটে বায়না ছিল। আর ভাল্লাগে না। এবার কদিন বিশ্রাম নেবো ভাবছি। আসছে সপ্তাহে আবার কাটোয়ার যেতে হবে। বড়ো আসর আছে।

—তা ভালো। বলি, দিনমান যে খেটে মরছ, তা কার জন্যি, নিজের জন্যি একটু ভাব।

হাসে তুলসি। দাওয়ায় পা দিতে দিতে বলে, সবই আমার কৃষ্ণমাধবের জন্যি গো। তিনি যেমনি ছোটান তেমনি ছুটি। না হলি, আমার এমন কী আছে যে, লোকে আমার গান শোনার জন্য হামলে পড়বে।

কথা বলতে বলতেই চোখ পড়ল রাফায়েলের দিকে। সেও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিল তুলসির দিকে। ভাবছিল এই কি সেই কীর্তনীয়া, যার কথা বলেছিল সুরেন গোঁসাই?

তুলসির মুখে হাসি, চোখে বিস্ময়। সে গোঁসাইমার দিকে চোখ ফিরিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, এটা কে গো মাসি? এ যে নদের নিমাই গো।

—আর বলিস নে বাপু। এক রাতে তোদের গোঁসাইজী ফিরতি পথে দেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আচে কেষনগর যাবে বলে। অত রাতে বাস পাবে কোথায়। তিনি ঘরে নে তুললে। বড় ভালো গায় গো। গলায় যেন মধু ঝরে। তা বাবাজীবন কীর্তনের গুরুর খোঁজে বেরিয়েছিল। বোষ্টমের আখড়ায় গিয়ে গান শিখবে। তা এই আখড়ায় রয়ে গেল।

—আখড়া? তোমরা আবার কবে আখড়া খুললে গো?

তুলসির কৃত্রিম বিস্মায়িত চোখের দিকে তাকিয়ে গোঁসাইমা উত্তর দিল, তা আমি আর কী বলব। তোদের গোঁসাইজী বলল, আখড়া বল আখড়া। আশ্রম বলো আশ্রম সবই হলো শ্রীবিষ্ণুর চরণ। তুমি বাবা এখানেই ঠাঁই নাও। তারপর সময় সুযোগ বুঝে তোমার ব্যবস্থা করছি।

—ও, এই হলো বেত্তান্ত। তা গোসাইজী মন্তর টন্তর দিয়েছে, নাকি শুধু গান দিয়েছে?

—নাহ্, কিছুই দেয়নি। এখন পরীক্ষে চলছে। গোঁসাই গান গায়, আর সে তুলে নেয়। আহা কী গান—কানে বাজে!

তুলসি ভালো করে রাফায়েলকে দেখে। মুখে মৃদু হাসি। তার এসব কথা ভালো লাগছিল না। রাফায়েলের এখানে দিন দশেক রয়েছে। এখন এদের কথাবার্তা বেশ বুঝতে পারে। সে উঠে রাস্তার দিকে চলে গেল।

তুলসির চোখ এড়ালো না। সে রাফায়েলের গমনপথের দিকে চেয়ে রইল। সে যেন তাকে এক অজানা বিস্ময়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাফায়েলের উনিশ-কুড়ির বাড়ন্ত শরীর, তার উচ্চতা, গৌরবর্ণ ত্বক, আর উদাসীন পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, এত সাক্ষাৎ গৌর গো। তবে নাদান। ও আমি গড়েপিটে নেবো। কী নাম গো মাসি, তোমার ও নিতাইয়ের?
.
.
কীর্তনীয়া
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।