কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

 
বাইরে উঠোনে যখন মহড়া চলে, ঘরের ভিতর নিরুর চোখে জলে ধারা বয়। পাশে রাখা গামছা দিয়ে মোছে। খুব খুশি হয় সে। কানে আসে রাফায়েলের কণ্ঠ। কতদিন আগের গান, কোথা থেকে যেন পেয়েছিল সে। এখন রাফায়েল গাইছে। বড়দিনের সময় বায়না আছে। এ গান সে গাইবে। নিরু মন দিয়ে শোনে ঠিক ঠিক গাইছে সে। দরদ ঝরিয়ে দিচ্ছে। রাফায়েলের সঙ্গে সে নিজেও নিঃশব্দে গেয়ে চলেছে—

উড়াও বিজয় পতাকা জয় যিশু বলে,
(আদি) মহোল্লাসে, হেসে, হেসে, সকলে মিলে।
বৈৎলেহেমের আকাশে ধর্মসূর্য উঠেছে
(তাঁর) জ্যোতির প্রভায় জাগ্রত হয় জ্যোতিষী দলে।
পরমপিতা প্রেমময়, পাঠাবেন প্রিয় তনয়,
(হবে) মহাশান্তি প্রেমপ্রীতি জগতের তরে।
স্বর্গদূতে মিলে গায়, ধন্য ধন্য দয়াময়,
(এসো) দূতের সাথে প্রেমে মেতে গাই সকলে।
যিশু প্রেম অবতার, যিশু প্রেমে পারাবার
(এস) দলাদলি সকল ভূমি শ্রী যিশু বলে,
ধন্য ঈশ-নন্দন, পাপ-তাপ-হরণ,
(বল) ধন্য যিশু ধন্য যিশু দুই বাহু তুলে।

এ গান কি পিতর মল্লিকের কাছ থেকে পেয়েছিল নিরু, নাকি অন্য কোথাও থেকে? হতে পারে কোনও ধর্মসভা থেকে। সে তো বুধবারের সভা বা সেবক সমিতির সভাতেও দল নিয়ে গিয়েছে কতবার। কত বছর ধরে গেয়েছে সে। এখন রাফায়েল গাইছে। এটাই তো পরম্পরা। কার গান খাতায় লেখা আছে, রাফায়েলকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

রাফায়েল গাইছে, আনন্দ আর সুশীল দুইভাই খোল বাজাচ্ছে উদ্দাম নাচ করে। আহা কী বোল আর চাঁটি! প্রভুদানের হারমোনিয়াম যেন গানের কথায় মধু ঢালে। একদিন নিরু কত কষ্ট করে দলটা তৈরি করেছিল। আজ রাফায়েল সেই জোয়াল কাঁধে নিয়েছে। এও তো খ্রিস্টজমিতে চাষ করা। বীজ ছড়ানো। নিরু গান শুনতে শুনতেই স্বপ্ন দেখে, সে হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে কীর্তন গাইতে গাইতেই বীজ ছড়িয়ে যাচ্ছে চষা জমিতে। আপন মনে এগিয়ে চলেছে জমির ঢেলা ভাঙতে ভাঙতে। একদিকে বীজ ছড়াচ্ছে, আর সেই বীজ থেকে বেরোচ্ছে চারা। সেই চারাও কেমন বড়ো হয়ে যাচ্ছে। সবুজ চারা বেরিয়েছে। নিরু হাসে নিজের মনে বলে, প্রভু তোমার অসীম দয়া। দীনদয়াল, তুমি আছো তাই আছি। জীবন নিয়ে তবে খেলছি কেন কানামাছি!

—বাবা!

নিরু চোখ মেলে! তার স্বপ্নের চটকা ভেঙে যায়। ঘাড় তুলে দেখে রাফায়েল চৌকির নিচে হারমোনিয়াম রেখে দিচ্ছে। গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে মায়ের তৈরি হারমোনিয়াম-জামা। আগে যে ছোটো টেবিলটার উপর হারমোনিয়াম রাখা হতো, এখন সেটা দখল করেছে গুচ্ছের ওষুধের শিশি আর ট্যাবলেট, জলের গ্লাস।

—বাপ এলি? শেষ হলো?

বাবার কাতর স্বর, শব্দগুলো বোঝা যায় তবে গলায় ঘড়ঘড়ানিও ধরা দেয়।

—হ্যাঁ।

—সবাই চলে গেছে?

—হ্যাঁ। দাঁড়াও তোমায় খেতে দি। স্টোভ ধরিয়ে একটু গরম করে নিয়ে আসছি।
.
.

কীর্তনীয়া
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।