ছায়াবৃতা।। সুনীল সেনশর্মা।।

গ্রামের প্রান্তে মোসুপের সামনের ছোট্ট মাঠের মধ্যে তখন বিশাল গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে আগুন ও আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুণ্ডের চারিদিকে প্রায় পনেরো কুড়িটি ছেলেমেয়ে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমাকে পৌঁছে দিয়ে গামরা বিদায় নিল। ছেলেছোকরাদের নাচের আসরে বুজুরুকদের (বৃদ্ধ) থাকতে নেই। এটাও রেওয়াজ।

সেদিন চাঁদনি রাত—কিন্তু হিমালয়ের হিমেল জমাট কুয়াশা ভেদ করে সেদিন চাঁদের কেরামতি দেখাবার হিম্মত ছিল না। অস্পষ্ট নিস্তেজ আলোর কুহক বিস্তার করেছিল শুধু—অগ্নিকুণ্ডের আভায় যতটুকু আলো হয়েছিল, তার মধ্যে দেখলাম, আবর মেয়েদের চুল হ্রস্ব করে ছাঁটা—প্রায় ছেলেদের মতো। পরনে বেড় দেওয়া কাপড় হাঁটু পর্যন্ত—ঊর্ধ্ববাস এক একটা হ্রস্ব কাঁচুলি, গলায় মালা।

আমি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে ছড়ার মতো গান গেয়ে উঠল। হাতে তার সন্ন্যাসীদের মতো একটা চিমটা—আর তার মধ্যে লোহার বলয়। গান করছে আর হাত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তাল দিচ্ছে সেই চিমটায়। সমস্বরে ছেলেমেয়েরা সেই গানের পুনরাবৃত্তি করছে। সকলে হাত ধরে বা কোমর ধরে একে একে সারিবদ্ধ হলো। একটু পিছিয়ে একটু সামনে এগিয়ে তালে তালে নাচতে লাগল আর অগ্নিকুণ্ডের চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল। ওদের নাচের ধরনটা অনেকটা সাঁওতালদের মতো—তবে ততটা ছন্দোবদ্ধ নয়, ততটা উত্তাল এবং উদ্দাম নয়, অনেক থিতানো। ওদের একটা গান শেষ হতেই দল ছেড়ে দুটি মেয়ে এগিয়ে এসে দুদিক থেকে আমার দুটো হাত ধরে দলের মধ্যে নিয়ে চলল। কী বিপদ! একেই সারা দিনের পথশ্রমের ক্লান্তি, তায় খিদের চোটে নাড়িভুঁড়ি ওলটপালট হবার জোগাড়—এর ওপর যদি আবার নাচতে হয় তবেই হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওদের নাচ গানের তখন উদারা থেকে মুদারা তারার দিকে ঊর্ধ্বগামী অবস্থা। আমি দুই দিকে দুই আবর কন্যার মধ্যম পুরুষ হয়ে তালে তালে পা ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝেই সবুট পা ওদের পদযুগলের উপর ন্যস্ত করছি। ওরা আমার করুণ অবস্থা দেখে হেসে আমাকে ইশারায় তাল বোঝাবার চেষ্টা করছে—আর মুখে গানের ধুয়ো আর পায়ে সমতালের সামঞ্জস্য রেখে চলেছে। এমনি করে প্রায় মিনিট পনেরো পরে একটা গান শেষ হতে নাচ থামল। ওরা আবার আমাকে এগিয়ে রেখে এল—আমার জন্য আনা ছোট্ট কাঠের একটা বেঞ্চির দিকে। এই ফাঁকে আমি রামের বোতলটা খুলতেই সকলে যে যার বাটি বের করল। ক্লান্ত নর্তক-নর্তকীদের এখন একটু বিশ্রামের সময়। তারিয়ে তারিয়ে ওরা রাম খাচ্ছে আর প্রায় সকলেই একটা করে সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়েছে।

আমি দোভাষীর কাছে জানতে চাইলাম ওদের গানের ভাষার অর্থ। আমার ধারণা হয়েছিল এগুলো ওদের কোনো নিজস্ব সংগীত। সুরটা অবশ্য চেনা-চেনা লাগছিল। কিন্তু এ সুর কোনো দেশকালের ব্যবধানে পরিবর্তন হবার সুর নয়। যেমন পদ্মার মাঝির ভাটিয়ালি আর ভল্গার মাঝির গানের সুর এক হয়ে যায়, যেমন বাংলার পল্লীর জেলেদের জাল ফেলার সুরের সঙ্গে বর্মার জেলেদের সুরের মিল খুঁজে পাওয়া যায়—তেমনি এদের গানের সুরে আমার মনে হয়েছিল আমি গ্রামবাংলার কিশোর-কিশোরীর কাছে শোনা এমনি গানের সুর শুনেছি—এমনি শীতের রাত্রে। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দল বেঁধে এরা বেরুতো বাস্তুপূজার উপচার সংগ্রহ করতে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সকলের জন্য অজস্র ধনসম্পদ কামনা করে টানা টানা সুরে পূজার জন্য চাল-কড়ি চাইত—

'আইলাম লো শরণে,
লক্ষ্মীদেবীর বরণে,
লক্ষ্মীদেবী দিলেন বর,
চাউল কড়ি, বিস্তর...।'

শীতের রাতে ঝিমানো চাঁদের ম্লান আলোয় কুয়াশা-ঘেরা গ্রাম তখন প্রায় সুষুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে—এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় একরকম টানা সুরে গৃহবাসীর জন্য অজস্র শুভকামনা জানিয়ে যাচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। মানুষের আনন্দের, বিষাদের, হর্ষের সুর দেশ দূরত্বের ব্যবধানের ধার ধারে না বোধহয়।

দোভাষীর কাছে শুনলাম এ গানগুলি আমার প্রশস্তি এবং গায়কের স্বরচিত। 'আমাদের গ্রামে নিগমের পদধূলি পড়েছে। আজকে দৈনীপাল্লা আমাদের উপর খুশি হয়েছে—তাই তো চাঁদের এত আলো; আর চাঁদের আলোর প্রাচুর্যের মতো নিগম আমাদের আজ টাকা পয়সা আর আপা দিয়ে খুশি করবে'—ইত্যাদি। ও হরি! এই গান! কিন্তু তা হলেও আমি তো এতক্ষণ এই সুরেই তন্ময় হয়ে ছিলাম।

ভাষা যাই হোক- একটা পরিচিত সুর প্রাণের মধ্যে তুফান তোলে—সুদূর অতীতের চেনা প্রাণের অতি প্রিয় পরিবেশ সৃষ্টি করে—ফিরিয়ে নিয়ে যায় এমন এক দেশে যা স্বপ্নের দেশ হয়ে গেছে এখন—যা শুধুই স্মৃতি।

সে দেশে সোনার গাছে হীরের ফুল ফুটত না, নদীর জলে থাকত না রূপকথার সোনা রুপোর মাছ। কিন্তু আজকের দিনে সে-দেশের গাছে ঝুলন্ত ফলের রাশি, নদীতে মাছের ঝাঁক, বাতাসে মধুর শান্তি, আকাশে স্বচ্ছ জ্যোৎস্নার কুহকময় আবেশ—সব-কিছুর সমন্বয়—বাস্তব হয়েও রূপকথারই শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হলুদ বনে যে দিনটি হারিয়ে গিয়ে মনের সুখ হারিয়েছিল—আজ ওদের গানের সুর আমাকে যেন তারই একটা অংশ ফিরিয়ে দিল।
.
.
.
ছায়াবৃতা
সুনীল সেনশর্মা

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা

সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।