এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ কি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ হবে। বালুরঘাট থেকে এঘাট-ওঘাট ঘুরে যখন ভদ্রেশ্বর স্টেশনে নামলাম, প্রথমেই মায়ের বৈধব্যাবস্থার ছবিটা মনে ভেসে উঠল, যেমন আগে বলেছি। প্রত্যেক সন্তানের কাছেই মায়ের একটা বিশেষ স্থায়ীরূপ, পাকাপাকি ভাবে থাকে। কখনো তা কল্কা-পাড়ের সাদা শাড়ি পরা, কানে কানপাশা বা কানবালা, নাকে নাকছাবি। কখনও বা হাতে অনন্ত। তাছাড়া, শাখা, নোয়া, পলা তো আছেই এবং গলায় হার। বৈধব্যের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের এই সমুদয় সম্ভার যেন একটা প্রবল হাহাকারের মতো সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে ফুরিয়ে যায়। সেই শূন্যতার মুখোমুখি হঠাৎ কীভাবে গিয়ে দাঁড়াব সেই ভাবনাটা যেন স্টেশন প্ল্যাটফর্মে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ, গোটা রাস্তা এই বিষয়ে আমার যেন কোনো চেতনাই ছিল না।

রিক্সা থেকে নেমে গেটের সামনে আমি যেন একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে একটা অদ্ভুত বিকৃত-প্রায় গলায় ডাকলাম—'মা'। আমার গলা শুনে মা মেঝেতে বসা অবস্থা থেকে উঠতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন—উনি বলেছিলেন,—'ওর জন্য আমি যেতে পারছিলাম না। ও আমাকে আটকে রেখেছে।' মায়ের এবং বাবার এইসব উক্তির মধ্যেও রয়েছে সুদীর্ঘ লড়াইয়ের অভ্যাস। নইলে কে কাকে সংসারে আটকে রাখতে পারে? যারা কাছে ছিল, কেউই তো তাঁকে ছেড়ে দিতে চায়নি। আমি কাছে থাকলেও কি তাঁকে আটকে রাখতে পারতাম?

এসব ক্ষেত্রে লোকে বলে, আমি কাছে থাকলে অন্তত শেষ দেখাটা দেখতে পেতাম। তখনকার বাস্তব কর্তব্যগুলো করতে পারতাম। বিনয়দাকে বলে গিয়েছিলাম, তিনি যেন কোনো আপৎকালে আমার দাদাদের পাশে দাঁড়ান। মায়ের কাছে পরে শুনেছি, তিনি তো দাঁড়িয়েছিলেনই, আমার অফিসের সব সহকর্মী বন্ধুদেরও ডেকে এনে যাবতীয় কর্তব্যকর্ম এমনভাবে সম্পন্ন করিয়েছিলেন যে ভদ্রেশ্বরের পাড়া-প্রতিবেশীরা বলেছিল যে, এ যেন এদেরই সবার বাবা মারা গেছেন। শেষ সময়ে উপস্থিত থাকলে, এর চাইতে অধিক আর কী হতো?

মা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন। দোতলার থেকে কান্নাকাটির আওয়াজে আমাদের সর্বকনিষ্ঠ ভাই মন্টু নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,—'দাদা, তুই ওরকম ভেঙে পড়লে মা-ও মারা যাবে। তুই মা-কে সান্ত্বনা দে।' শোকের একমাত্র নিরাময়কারী হচ্ছে সময়। যত সময় যায়, ততই শোকের বেগ স্তিমিত হতে থাকে। শোকের নিয়মই তাই। ক্রমশ মা শান্ত হলেন।

সন্ধ্যা নাগাদ দাদা, মেজদা অফিস থেকে ফিরল এবং সবাই মিলে নানারকম স্মৃতিচারণ করতে বসে পরবর্তী কর্তব্যাকর্তব্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে করতে শোকাবেগ লঘু করতে মনোযোগী হলাম। মানুষের অস্তিত্ব এমন একটা ব্যপার যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে জীবিত, ততক্ষণ, তার ভার যেন শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো পরিবারের সবাইকে ঘিরে থাকে। দেহ জরাজীর্ণ, চলচ্ছক্তি রহিত, নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণাকাতরতা সত্ত্বেও সে আছে—এই বোধটা মানুষ যেন কিছুতেই হারাতে চায় না। দীর্ঘকাল রোগভোগের জন্য পরিবারস্থ জনেরা, অনেক সময় এর থেকে অব্যাহতি যে কামনা করে না, এমন নয়। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বুঝেছিও যে তা একান্তই সাময়িক। নিতান্ত আত্মস্বার্থী না হলে বোধ হয় কেউই তার রুগ্ন আত্মজনের অনস্তিত্ব কামনা করে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু জীবিতাবস্থার মানসিক সন্তুষ্টি এবং তার ভারবত্তা এক স্বর্গীয় স্বস্তি। ব্যাপারটা বোঝা যায়, যখন দেখি, অচল, অসার, অকর্মণ্য এক ব্যাধিগ্রস্ত, শয্যায় লীন হয়েও প্রাণত অস্তিত্ববান। যেই মুহূর্তে তার অনস্তিত্ব বাস্তব হয়, এক বিপুল শূন্যতা আমাদের গ্রাস করে ফেলে এবং আমরা প্রাণের ভার অনুভব করি। যে কোনো অবস্থায়ই থাকুক না কেন, যে কোনো মানুষ, সংসারের একটা বিপুল স্থান ব্যাপ্ত করে থাকে। তার মৃত্যু এই ব্যাপ্তিকে শূন্যতায় পরিণত করলে, আমরা এক অলৌকিক বোধে আবিষ্ট হই। প্রকৃতপক্ষে সংসারে সর্বাপেক্ষা অলৌকিক অনুভব বোধহয় এই অস্তিত্ব, অনস্তিত্বের লীলা। হ্যাঁ, এই অবস্থাটাকে আমি চূড়ান্ত নাস্তিকতা সত্ত্বেও 'মহাকালের লীলা' বলে বিশ্বাস করি। নচেৎ এর ব্যাখ্যা কোথায়?

বাবার চৌকিখানা স্থানচ্যুত করা হয়েছে। কারণ, মানুষটির অবস্থান চৌকিখানাকে যেন পূর্ণতায় অস্তিত্ববান রেখেছিল, তার অবর্তমানে শূন্যতা যেন মূর্তিমান হয়ে তাকে অসহ্য করে তুলেছিল, তাই তার অপসারণ। আর সেদিন সেই চৌকিখানার শূন্যস্থানে মেঝের উপর মায়ের তখনকার অবস্থান, বাবার ভারহীন অস্তিত্বকে যেন আরও অধিক অনস্তিত্বে পরিণত করেছিল। সেই থেকে একটানা প্রায় তিন-চার মাস অবধি রোজ রাতে মা সমানে কেঁদে যেতেন। কী যে বুক-ফাটা সে কান্না, তা যে শোনে সেই শুধু বোঝে। সেটা গল্পকথা শুনে বোঝা বা অনুভব করা সম্ভব নয়। প্রিয়জন বিয়োগে শোক স্বাভাবিক। কিন্তু তার তো একসময় পরিসমাপ্তি প্রয়োজন, নইলে তো মৃত্যু জীবনের উপর স্বেচ্ছাচারিতা করবে। 
.
.
.
এপার বড়ো মাঘ মাস, ওপার বড়ো কুয়া
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী 

মুদ্রিত মূল্য : ২৭০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।