কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

সুরেন গোঁসাইয়ের ঘর ছেড়ে তুলসির ঘরে এসে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। এক কামরার বড় ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, পাকা পায়খানা। সবই সে করেছে কীর্তন গেয়ে। ঘরের ভিতর দামি খাট, বিছানা। জমিটুকু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেই ঘেরা পাঁচিলের একদিকে ইটের ভিতের উপর টালির ছাউনির বেড়ার ঘর। এটাই ওর মহড়ার জায়গা। তুলসি ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। রাফায়েল দেখে, আর ভাবে এটা তো কোনও বোষ্টমীর আশ্রম নয়, এত সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, বাহ্, বাড়িটাতো বেশ!

—তোমার পছন্দ নতুন গোঁসাই? এ বাড়ি মনে করলে তোমারও হতে পারে।

—আমার হবে কেন?

ওর থুতনিতে হাত ছুঁইয়ে তুলসি উত্তর দেয়, এখন তো আর তুমি-আমি ভিন্ন নই। কানে মন্তর পাওনি তো কী হয়েছে? কণ্ঠী বদল নাই বা করলাম, মন বদল করতে কতক্ষণ!

রাফায়েল ওর হেঁয়ালি ঠিক বুঝল না। সে চুপ করেই রইল।

ঘরে উঠে তুলসি বলল, তুমি স্নান সেরে নাও, নতুন গোঁসাই। দেখ নতুন কাপড় আছে পরে নিও।

রাফায়েল উত্তর দেয়, সকালে তো স্নান করে নিয়েছি।

—ও। তা হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় পালটে ফেল।

সেই শুরু। তারপর থেকে তুলসি ওকে নিজের মতো করেই ভেবে নিয়েছে। দিনের বেলায় বারান্দায় বিছানা করে দিয়েছে। অনেকদিন পর সন্ধ্যেবেলায় জলখাবার! তারপরেই ঘরের মেঝেয় হারমোনিয়াম বের করে তুলসি বলল, একটা গান শোনাও নতুন গোঁসাই। শুনে মনটা জুড়াই।

—কী গাইব?

—তোমার যা মন চায়। বৈষ্ণবের গানও গাইতে পারো। তোমার আগের শেখা গানও গাইতে পারো।

—তাহলে একটা যিশুর গানই গাই। আমরা বড়দিনের সময় গাইতাম।

হারমোনিয়াম কোলের কাছে ধরে গান শুরু করল—

ও শুভ নিশায় আজি জানাতে সবাই,

গাহে যত দূতদল আকাশের গায়

বহুদিন বাদে ভাবে বিভোর হয়ে রাফায়েল গাইছে। এই একমাসেও গেয়েছে অনেকবার, কিন্তু তার মধ্যে প্রাণ ছিল না। আজ সে গানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। গানের শেষ দিকে যখন সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে—

পরাণে পরাণে নব জাগরণে, 

প্রীতির লহরী ভরিয়া যায়।

হঠাৎ দেখে তুলসিও তার সঙ্গে গেয়ে চলেছে। দু হাত ওপরে তুলে, নেচে নেচে যেমন সে কীর্তন দলে গাওয়ায় সময় গায়। একসময় লয় ঢিলে করে গান থামাল। তখনই হলো সেই অঘটন। তুলসি ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে অধর রঞ্জিত করল। রাফায়েল স্থাণুবৎ হয়ে গেল। কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু বাড়ন্ত শরীর কুড়ির প্রাকযৌবন যেন হিল্লোলে কল্লোলিত হচ্ছিল। সে ভয় পেয়ে গুটিয়ে গেল। তুলসি নিজেকে সংযত করে বলল, কতদিন এমন গান শুনিনি। তোমার ওই যিশুর গানেও যে এত মধু আছে, জানতাম না।

.

.

কীর্তনীয়া 

সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত 

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ






Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।