রহু চন্ডালের হাড়।। অভিজিৎ সেন।।

রমজানের নির্দেশে জামির লড়াই করে। পেটে খোরাক জোটে না সবদিন। তরমুজের খেতে কাজ করতো হয় বলে গঞ্জের ঘাটে কুলির কাজে যেতে পারে না। লুবিনির সামান্য রোজগারের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়।
    তারপর সেইসব জালিতে ফল আসে, ফল ক্রমশ বড়ো হয়। নতুন জালি আসে, ভ্রমর আর মৌমাছি সারা খেতে উড়ে বেড়ায়, প্রজাপতি লতার উপর দোল খায়। তারপর ফলের রঙ সাদা থেকে হালকা সবুজ হয়, তারপরে গাঢ় সবুজ, তারপরে ক্রমে কালো রঙের বৃহৎ আকারের তরমুজ খড়ের বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকে।
    এসব দেখে রমজানের মতো জামিরের কলিজা ঠান্ডা হয়, খিদের পোকা আর পেটের ভেতর মোচড় মারে না, অথবা মোচড় মারলেও, আর তেমন করে মালুম হয় না জামিরের।
    তারপর চৈত্রের শেষে যখন তরমুজ হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়, তখন তরমুজ খেতের আসল দুশমনেরা এসে হাজির হয়। এরা ধসা রোগ বা কাটাপোকার থেকেও ভয়ঙ্কর। এদের বাগ মানানোর কোনও উপায় রমজানের জানা নেই।
    এরা সব শহর ও আশপাশের বাবুঘরের জোয়ান ছেলে। দূরের থেকে তাদের আসতে দেখে রমজান বলে, পতিবার ভাবি আর তরমুজের চাষে যাব না, এতো উৎপাত আর সহ্য হয় না। কিন্তু মন যে মানে না। এতো পরিশ্রমের ফসল, দেখো, এখন কেমন নিজের হাতে লুটেরার কাছে তুলে দিতে হয়।
    জামির বলে, কেমন?
    নিজেই দেখতে পাবা।
    উৎপাত করবে?
    উৎপাত। না দিলে বুকে ছুরি বসাবার পারে। সুলতানপুরের আখের চাষই উঠে গেল এই উৎপাতে। একশো বিঘার খেত এরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, সে জানো?
    পুলিশে খবর দেয় না মানুষ?
    পুলিশে খবর দেবে? যাবার হবে না তোমারে গঞ্জের হাটে, টাউনের বাজারে? সেথায় এরাই তোমার জীবনমরণের হকদার।
    বেশি অপেক্ষা করতো হয় না। নৌকা করে ছোকরারা এসে খেতের কাছে নামে। রমজান গম্ভীর হয়ে থাকে। দলের মাতব্বর ছোকরা এগিয়ে এসে বলে, চাচা, তরমুজ খাবো। রমজান বলে, আলবাৎ খাবা। তবে গাছেৎ কেহ হাত দিয়েন না, বাপেরা। দুটো ছিড়া দিছি, খুশি মনে চলি যান। 
    দুটা! আমি দশজনা, চাচা। কম করে পাঁচটা তো চাইই।
    অতো খাবার পাবেন না বাপেরা। এক একটার ওজন দেখিছেন পাঁচ সের, ছয় সের। লষ্ট করার সামগ্গিরি লয়, বাপ। ওরে আবু দুডা তরমুজ ছিড়া দে, বাবুগেরে।
    ছোকরারা উচ্চ হাসে। কেউ মন্তব্য করে, দুটা? অ্যাঁ? মগের মুলুক। 
    একজন ততক্ষণে খেতের ভেতর থেকে একটা তরমুজ ছিঁড়ে ফেলেছে। গাছটার দফা শেষ। মাঝামাঝি জায়গায় লতাটা ছিঁড়ে গেল। তার মানে বাকি ফলগুলোর দফা শেষ।
    আবু লাফ দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, এডা কী করলেন? গাছটার সব্বোনাশ করলেন?
    ছোকরা পাত্তা দেয় না। বলে, আবিব্বাপ, লাপাচ্ছে দেখো, যেনোো মারবে! 
    রমজান উঠে দাঁড়ায়। কাছে এসে বলে, আগেই আপনাগেরে নিষেধ করলাম, গাছেৎ হাত দিবেন না, শুনলেন না কথাটা?
    মাতব্বর ছোকরা বলে, বেকুব, অতি বেকুব এই ছোকরা, বুঝলে চাচা? তা যাকগে, অঢেল হয়েছে এবার তোমার, দু-চারটা নষ্ট হলে গায়ে বাজবে না। এই পাঁচটার বেশি তুলো না । 
    দলপতির নির্দেশ ছোকরারা খেতের মধ্যে ঢোকে। জামির ভাল করে দেখে এদের। বিশ বাইশ বছরের বাবুঘরের ছেলে সব, কেউই শিশু নয়। আর দেখ, কী অত্যাচার।
    রমজান হাঁ-হাঁ করে ওঠে, আরে করেন কী? করেন কী? 
    দলপতি ছোকরা রমজানের দুই ঘাড়ের উপর হাত দিয়ে চেপে বসিয়ে দেয়। মুখে বলে, একদম কথা নয়। চাচা। ভালোমুখ করে খেতে চাইছি, ভালোমুখে দিয়ে দাও।
    রমজান হতভম্ব হয়ে যায়। আবু, রমজানের দ্বিতীয় ছেলে, লাফ দিয়ে গিয়ে খেতের মাঝখানে দাঁড়ায়। বলে, খবরদার খেতের বাইরে যান সব। তার হাতে একটা হেঁসো।
    জামির দেখে, যে খেতের মধ্যে ছোকরারা ঢুকেছে সেটা তারই। সে এবার তার বিশাল দেহটি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কটিদেশের সামান্য বস্ত্রখণ্ড ছাড়া তার সারা শরীরই উলঙ্গ। সে ধীর পদক্ষেপে তার খেতের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোকরারা তাকে দেখে গাছ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। জামির শান্ত অথচ স্থির গলায় বলে, খেতের বাইরে যান, বাবুরা। 
    এ কথায় কাজ হয়।
    সব ক-জন গিয়ে মাতব্বরের পাশে দাঁড়ায় এবং ক্ষুব্ধ চোখে জামিরকে দেখে। 
    জামির নিজে খেতের বাইরে এসে বলে, রমজান ভাই দুডা দিবার চায়েছেন, তাথে আপনাগেরে হবে?
    জামিরের হাত দুটি বড়ো বেশি লম্বা, আর তার উপরে মোটাসোটা শিরাগুলো ঈষৎ আন্দোলনেই সাপের মতো কিলবিল করে ওঠে।
    জামির হাতের তালু দুটিকে হতাশায় ভঙ্গিতে উলটে দেয়। বলে, তবে লাচার। মেহন্নতের ফসল, বাবুরা, হারামের না। আর এটটা কথা, এই বুড়া মানুষটাকে অপমান করে ঠিক করলেন না। আপনার বাপের বয়সী লোক।
    কী অপমান করলাম?
    ওনারে ঘাড়ে হাত দিয়ে বসালেন না আপনি? ইটা ঠিক লয়।
    এতে অপমান হোলো?
    হোলো। আর এতে মানে হয়, ওই বুড়ার থিকা আপনার গায়েৎ জোর বেশি। বুড়ার থিকা যে জোয়ানের গায়েৎ জোর বেশি, ইটা দেখাতে কি পোরমানের দরকার হয়? খ্যামতা থাকে আপুনি ওই বুড়ার বেটার ঘাড়েৎ হাত দেন।
    জামির ইঙ্গিতে আবুকে দেখায়।
    সর্দার ছোকরা চাপা ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়ে। বলে, দরকার হলে তাও পারি। 
    আরেকজন এগিয়ে এসে বলে, তুমি কে চাঁদ? তোমাকে তো চিনলাম না? 
    আমি এক চাষা, দেখবাই পাচ্ছেন।
    কথাটা বলতে পেরে এই অস্থির সময়েও জামিরের বুকটা ভরে ওঠে। চাপা উত্তেজনার কম্প তার ভিতর থেকে যেনো কেটে যেতে থাকে। সে বলে, দুডা লয়, তিনডা তরমুজ নিয়া চলি যান বাবুরা।
    দলপতি পিছন ঘুরে দাঁড়ায়। জামিরের উদারতায় কান দেয় না। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলে, চাষা তুমি নও। তবে তুমি কে সে খোঁজ করবো।
    দলটা গিয়ে আবার নৌকায় ওঠে। জামির নৌকাটাকে চলে যেতে দেখে রমজানের পাশে এসে বসে। কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। রমজান বলে, কাজটা খারাবি হোল। 
    আবু বলে, ভালো কোন্ কামটা? খ্যাতটা নকরা-ছকরা করবা দিলে সিডা ভালো হোত?
    রমজান বলে, এরা ঝামেলি পাকাবে।
    জামির এতক্ষণের ঘটনা থেকে স্থির মাথায় সারসংক্ষেপ করে। শেষে বলে, রমজান ভাই গরিবের সবেতেই ঝামেলি। এসব ঝামেলি নিয়াই বাঁচবা হবে, লচেৎ ভিখ মেঙ্গে খাওয়া লাগে।
.
.
.
আসছে অভিজিৎ সেনের চিরায়ত উপন্যাস
.
অলংকরণ : শুভেন্দু সরকার
.
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।