এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

একটা যুগ ছিল। সেটা আলিবর্দি খাঁয়ের আমল। তখন বর্গীর উৎপাত। বৃদ্ধ নবাব প্রায় তরুণের মতো এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে উল্কার বেগে বর্গীদের হামলার মোকাবিলা করছেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর প্রজাদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। তখন রাঢ় থেকে বঙ্গে বাঙালি আশ্রয় নিচ্ছিল। তার পর বহু যুগ গত হয়েছে। ভাগীরথীর পুব পার ধরে তাবৎ গঙ্গাহৃদয় অধিবাসীরা নতুন করে প্রতিষ্ঠা স্থাপন করে ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ করে স্থিতিশীলতা লাভ করেছিল।

কিন্তু বাঙালি জন্মসূত্রেই উদ্বাস্তু। সেই কোন পাল যুগে তার জন্ম হয়েছিল, তারপর ক্রমে সদ্ধর্ম লুপ্ত হয়ে পরদেশি সেন-বংশীয়রা রাঢ়বঙ্গের সাম্য অভিযাত্রার অভিমুখ বদল করে ব্রাহ্মণ্য অভিযাত্রা অব্যাহত করল। সেই ব্রাহ্মণ্য ভেদাচারের ফলে বাঙালি ক্রমশ ছিন্নমূল হয়ে একবার পুব, আরেকবার পশ্চিমে ছোটাছুটি করতে থাকল। এটা যেন অতঃপর বাঙালির অদৃষ্টলিপিই হয়ে দাঁড়ালো। আমার পরিবারের রাঢ় অঞ্চলে সম্ভাব্য প্রবাস এই উদ্বাস্তুয়ানারই ফল।

আমার পূর্বপূরুষ, শুনেছি, রাঢ় অঞ্চলের কোনো এক 'ভূম' রাজ্য ছেড়ে ঢাকা বিক্রমপুরের সুবর্ণগ্রামে বসতি করেছিল। শিখরভূম নামক একটি 'ভূম রাজ্য' সেন বংশীয় রাজাদের অন্যতম সামন্ত রাজ্য ছিল। তুর্কি আক্রমণের অব্যবহিত পরে সেন বংশ সোনার গাঁ তথা পূর্ববাংলায় আরো একশো বছর রাজত্ব করেন। শোনা যায়, তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় আমাদের পূর্বজরা বিভিন্ন সময় পূব বাংলার নানা স্থানে কখনও ভূম্যাধিকারী, কখনও চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এসব কথাই কিংবদন্তিমূলক এবং পারিবারিক পরনকথার কথা।

এখন উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার লগ্নে, তৎসহ বাংলাও ভাগ হলে সেই উদ্বাস্তুয়ানা চলমানই আছে। রাঢ়ে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে তথাকথিত হিন্দু সম্প্রদায় যেমন প্রতিষ্ঠা পায়, প্রায় সমসাময়িক ভাবেই, বাংলায়, অর্থাৎ পুব বাংলায় মুসলমান সম্প্রদায়ের বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ভূমি আবাদের কথা যদি ধরা হয়, পূর্ব বাংলার জলা, জঙ্গল অধ্যুষিত প্রায় অধিকাংশ অঞ্চলের ভূমিই মুসলমান সম্প্রদায়ের দ্বারা আবাদিকৃত। উদাহরণ স্বরূপ বাগেরহাট তথা খুলনার সুন্দরবন অঞ্চলে খান জাহান আলি খান ও তাঁর ষাট হাজার মুরিদের দ্বারা গোটা অঞ্চলের আবাদের কাহিনীর উল্লেখ করা যেতে পারে। তুলনামূলকভাবে পূর্ব বাংলায় সেন রাজাদের শতবর্ষীয় শাসনকালে ভূমি আবাদ বা নগর পত্তনের বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে এসব কথা গবেষণামূলকভাবে ব্যাপক বিশ্লেষণে না বললে আনুপূর্ব বলা সম্ভব নয়। তবে একথাও বলা প্রয়োজন যে, ভূমি উদ্ধার কার্যে বঙ্গের নিম্নঅঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী, যাদের ইদিলপুর তাম্রশাসনে 'চণ্ডভণ্ড' নামে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তথাকথিত চণ্ডাল জাতীয় প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদেরও অবদান কম নয়। সাম্প্রদায়িক অসহনশীলতার জন্য বাংলা ভাগ অবশ্যম্ভাবী হলে, হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বাঙালি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের উভয় সমাজই ক্রমান্বয় উদ্বাস্তুতার শিকার হয়ে পড়ে।

কাল রবিবার। আমরা অফিসের বন্ধুরা বিনয়দার বাড়ি নেমন্তন্নে যাব ভদ্রেশ্বরে। এই যাওয়ার অন্যতর উদ্দেশ্য, হুগলি জেলার এই অঞ্চলে আমার পরিবারের জন্য একটি গৃহ-স্থাপন। এক যুগের ছিন্নমূলীয় জীবনে আমাদের সপ্তম কি অষ্টম পূর্বপুরুষ রমাপতি সেন কবিবল্লভ মশাই বরিশালের কেওড়া গ্রামে একটি একতলা বিশিষ্ট পাকা বাড়ির পত্তন করেছিলেন। তারপর তাঁর বংশীয়রা সেই বাড়িটিকে দ্বিতল আকৃতি দিয়ে প্রায় প্রাসাদোপম 'বড়ো বাড়ি' নামের বাড়িটির স্থাপন করেন। তারপর এই বংশে, আমাদের ধারায় আমরা রাঢ় অঞ্চলে পুনরায় এখন বাড়ি নির্মাণের প্রচেষ্টার স্বপ্ন দেখছি। এই হুগলি নদীর পশ্চিম পাড় থেকে একদা পদ্মাপাড়ের ভূমিতে সূর্য দীঘল বসত বাড়ি ক্রমশ ভিটে বদল করতে করতে আজ আবার ভিটে বদল করতে চলেছে। এখনও বলতে পারছি না, এটাই শেষ পাল্টানো কিনা। সব মানুষই বোধহয় আসলেই যাযাবর। আমার এই অনুমানানুসন্ধান যতই প্রাচীন মনে হোক না কেন অনন্তকালের হিসেবে তা হিসেবেই আসে না। কিন্তু অত বড়ো এবং প্রাচীন কালানুসন্ধান, অর্থাৎ মানুষের উদ্ভব কালের কথা ছেড়ে যদি শুধু একটা বংশধারার অনুসন্ধান করি, তাও কি কিনারা করা যায়? সে এক অসম্ভব ব্যাপার। তবু স্থানীয় ইতিহাস প্রচেষ্টা এবং পারিবারিক কথা-কিংবদন্তী অনুসরণে আমাদের বংশধারার কিছুটা তথ্যানুসন্ধানের নিষ্কর্য উপস্থিত করার প্রয়াস করছি।
.
.
.
এপার বড়ো মাঘ মাস, ওপার বড়ো কুয়া
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী 

মুদ্রিত মূল্য : ২৭০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।