ছায়াবৃতা।। সুনীল সেনশর্মা।।

বমডিলা শহর ছাড়িয়ে কিছু উত্তরে বর্তমান রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই এই গিরিশ্রেণীর মধ্যেকার আর একটি গিরিপথ পাওয়া যায়। এটাই বমডিলা। গিরিশ্রেণী হঠাৎ যেন অবরোধ সরিয়ে নিল এক অপরূপ দৃশ্য দেখাবার জন্য। উত্তরে ঊর্মিমালার মতো গিরিশ্রেণী তুহিন-শুভ্র স্থায়ী বরফের মুকুট পরে প্রভাত সূর্যের প্রতিফলিত আলোয় ঝকমক্ করছে। যেন বীচি-বিক্ষোভিত সফেন সমুদ্র রামচন্দ্রের অদৃশ্য নির্দেশে চঞ্চলতা ত্যাগ করে মুহূর্তের মধ্যে স্থাণুরূপ নিল। আর সেই থেকে এমনি করেই শোভা পাচ্ছে। এই গিরিশ্রেণীর মুখ্য শৃঙ্গ গৌরীচেন।

কিন্তু এর আগে সোজা নীচের দিকে তাকালে আর এক দৃশ্য। দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের ঢালে ঘন সবুজের সমারোহ, এত সবুজ যে দূর থেকে ঘন কালো প্রতিভাত হয়। থরে থরে সাজানো পাইন, ওক গাছের সারির মধ্যে রডোডেনড্রনের সারি। ঘন কৃষ্ণ বনরাজির মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তবর্ণের রডোডেনড্রন যেন কৃষ্ণা পাহাড়ী-কন্যার ঘন কৃষ্ণ কেশরাজিতে করবীর শোভা। সাহিত্য এবং উপমা আমার আসে না, কিন্তু ভাষার দৈন্য অনুভব করি যখন এমন মহান, বিশাল এবং রকমারি বাহারি দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই, বর্ণনা করার ভাষার অভাবে। এ এক অন্য জগৎ, যার সঙ্গে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা মেলে না, পরিচিত কোনো উপমাতেই যার প্রকৃত বর্ণনা করা যায় না। এমনি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অপরিসর রাস্তা নেমে চলেছে নীচের উপত্যকার দিকে। পাইন গাছের শুকনো পাতায় ঢাকা রাস্তা—জীপের চাকায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে—সুন্দর ধূপের মতো হালকা গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আছে বাতাস। পাহাড়ী ঝর্ণা বাঁধনহারা হয়ে চঞ্চলা কিশোরীর মতো কখনও রাস্তার ওপর দিয়ে কখনও নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে কলস্বরে। উত্তরমুখী রাস্তার ডাইনে কামেঙ নদী অথবা তারই কোনো শাখা। জলের রঙে সবুজ বনানীর ছায়া—কখন অদৃশ্য সেই রঙই জলের রঙ হয়ে দাঁড়াল। পান্নার মতো সবুজাভ জলের মৃদু কলস্বর কখন গর্জনের মতো শোনাতে লাগল। রাস্তা তখন প্রায় ডিরাংজঙ গ্রামে পৌঁছে গেছে। নদী আর রাস্তার মাঝে—কোন যুগে পরিত্যক্তা নদীরই সমভূমি—আরও সমতল করা হয়েছে ডোজার ডাম্পার দিয়ে। হেলিকপ্টার নামার চত্বর, সৈন্যের ছাউনি এবং নেফা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্যাম্প। অনতিদূরে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানো কালো ছাউনিওয়ালা দুই মহলা বাড়ি—মধ্যে মধ্যে বৌদ্ধ গুম্ফার আকারে—না ওগুলো গুম্ফাই, পরে জেনেছি। সমস্ত দিকেই কেমন একটু স্বাতন্ত্র্য এত দূর পর্যন্ত যা দেখেছি, তার থেকে। অনেক কিছুই যেন পরিচিত—যেন আমার জানা সভ্যতার সঙ্গে মিলে যায় কোথায়। এই নদী, পাহাড়, গুম্ফা, এমনি ঘরের গঠন মনে করিয়ে দেয় সিকিম বা ভুটানের কোনো বসতিকে।

কামেঙের এই অঞ্চলটার অধিবাসী মম্পা। এরা সত্যিই এদের দক্ষিণের আকা বা ডাফলাদের থেকে অনেকাংশে স্বতন্ত্র। অন্তত সভ্যতার মাপকাঠিতে এরা তথাকথিত সভ্যদেশের সমগোত্রীয়। এদের লম্বা তিব্বতী ঢঙের আলখাল্লা পরা—জাফরানী রঙের আলখাল্লা, কোমরে বাসন্তী রঙের কাপড়ের কটিবন্ধ, মুণ্ডিত মস্তক অথবা অদ্ভুত ধরনের টুপি পরা, বহিরাগত কারও সঙ্গে কথা বলার ঢঙ লক্ষ্ণৌর তহজীব ও তামিজ্কে হার মানায়—টুপি খুলে দু-হাতের মধ্যে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করবে। যদি বহিরাগত আমার মতো ছন্নছাড়া না হয়ে পদমর্যাদাসম্পন্ন কেউ হন তবে গ্রামের সীমানা থেকেই মহাসমারোহে হবে তার আবাহন। কয়েক হাত লম্বা বিশাল পেতলের শিঙা, বড় ড্রাম ইত্যাদি বাজবে—সুরটি নেপালের যে-কোনো গ্রামের উৎসব-দিনের বাজনার মতো। যন্ত্রগুলিও অনুরূপ এবং আমার মনে পড়ে কোনো এক বইতে লাসার গুম্ফার বাইরে সারিবদ্ধ লামাদের হাতেও এমনি যন্ত্রের ছবি। চেহারায়, ব্যবহারে, পোশাকে এবং আনুষঙ্কিক বহু কিছু মিলিয়ে তিব্বতীদের আলাদা করে নেওয়া কষ্টকর। এদের ইতিহাসও তাই বলে।

.

.

.

ছায়াবৃতা

সুনীল সেনশর্মা

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা

সুপ্রকাশ 



Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।