বাঙালির শিকার স্মৃতি।। সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস।।

গত বছরের মতো এবারও অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম থেকেই বাঘের উপদ্রব শুরু হয়। সাতখানা গ্রামের লোক ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। জাফরনগরের বীর আসরে নেমেছেন।

আজ হিজুলী, কাল হালালপুর, তার পরের দিন জাফরনগর, প্রত্যহই গো হত্যার সংবাদ আসতে থাকে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বীরের অভিযান হয় শুরু। প্রত্যহই খোরাকের জন্য চাই একটা আস্ত গরু আর তাছাড়া জলযোগের জন্য দেশী কুকুর, ছাগল ও ভেড়া প্রায়ই প্রয়োজন হয়।

স্থানীয় শিকারী মহলে সাড়া জাগে। কেউ জানোয়ার চলা পথের উপর মাচা বাঁধলেন, কেউ মরী'র উপর বসে রাত কাটালেন, কেউবা লোক দিয়ে জঙ্গল ঘিরিয়ে বন পেটালেন; কিন্তু সবই বিফল হল। জাফরনগরের বীর যে বিভীষণের পরমায়ু নিয়ে এসেছে, ওকে মারে কে?

সংবাদটা মহাকুমা হতে সদরে গেল এবং সেখান থেকে গেল কলকাতা শহর পর্য্যন্ত।

এবার কলকাতা হতে মোটর বোঝাই হয়ে শিকারীর আমদানী হতে লাগলো; কিন্তু ফল কিছু হল না। টিফিন কেরিয়ার খালি করে ক্লান্ত দেহে ফিরে যেতে লাগলো।

সংবাদ পেয়ে আমেরিকান সৈনিকের দল এসে তাঁবু গাড়লেন জাফরনগরের বনের কিনারে। উজ্জ্বল তাদের স্বাস্থ্য, লোভনীয় তাদের পরিচ্ছদ, আর সকলের হাতেই একটা করে দামী মানুষ মারা রাইফেল।

গ্রামে গ্রামে সাড়া জাগে। এবার বাঘ মরবে নিশ্চয়ই। আমেরিকান কায়দায় শিকার আরম্ভ হ'ল। জাফরনগরের বীরের উপর একটা গুলিও পড়ল; কিন্তু ফল সেই পূর্ব্বের মতই রয়ে গেল।

তাঁবু উঠলো; কিন্তু গোহত্যা থামলো না। চৈত্র মাসের মধ্যে-ই বীর 'সেঞ্চুরী আপ' করলে।

অবশেষে:

২৪শে জ্যৈষ্ঠ। সকাল থেকেই অকাল বাদল নেমেছে। বিকেল বেলা তরুণ শিকারী শঙ্করনাথ কেবল চায়ের পেয়ালাটী শেষ করেছে এমন সময় বন্ধু অপূর্ব্বকুমারের চাপরাশী এসে সংবাদ দিল, জাফরনগরে গত রাতে এক বৃহৎ গরু মেরেছে, ডাক্তারবাবু (অপূর্ব্বকুমার) আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন, এখুনি যেতে হবে।

শঙ্করনাথ মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে মনটাকে শান্ত করবার চেষ্টা করলে; কিন্তু গাজনের সন্ন্যাসী চড়কের বাজনা শুনলে নাকি আর স্থির থাকতে পারে না—তাই তাকে সেই দুর্যোগের মধ্যে দিয়েই যাত্রা করতে হল।

ওরা যখন জাফরনগরে এসে পৌছাল তখন মেঘলা দিনের সন্ধ্যা নামতে আর বেশী দেরী ছিল না।

গত রাতে যার গরু নিহত হয়েছিল সেই পথ দেখিয়ে গন্তব্য স্থানে পৌছে দিয়ে গেল। নিবিড় জঙ্গলের মাঝে মৃত গরুটা পড়ে আছে। পাশেই নরম কাদার উপর পড়ে রয়েছে জাফরনগরের বীরের পদচিহ্ন।

অপূর্ব্বকুমার শঙ্করনাথকে সেই পদচিহ্ন দেখিয়ে বল্লে,—ধোঁয়া দেখে আগুনের গুরুত্বটা বোঝ।

শঙ্করনাথ মোটা গলায় শুধু একটা হুঁ দিল।

আকাশ থেকে আবার এক পশলা বৃষ্টি নামলো। এবার ওদের মুস্কিলে পড়তে হল। কাছাকাছি বসবার মত একটাও গাছ নেই। আর এখন এত দেরী হয়ে গেছে যে গ্রামের থেকে লোকও উপকরণ নিয়ে এসে মাচা বাঁধার সময় পাবে না। এদিকে বনের বুকে সন্ধ্যার ছোঁয়া লেগেছে।

অন্য কোন উপায় না পেয়ে ওরা মৃত গরুটার কাছ হতে হাত কুড়ি দূরে একটা বন তুলসীর ঝোপের মধ্যে ঢুকে বসে পড়লো।

অন্ধকারে ডুবে গেল সারা বনানী। পাশাপাশি স্থিরাসনে বসে দুই বন্ধু বাঘের ধ্যানে মগ্ন হ'ল। এদিকে জাফরনগরের বনের বনিয়াদি মশককুল ওদের ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণ করলে—তাদের রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ তারা কিছুতেই সহ্য করতে রাজী নয়। এর উপর প্রকৃতির অত্যাচার শুরু হল। শরৎকালের মত এক একখানা মেঘ ভেসে আসে, আর ওদের সঙ্গে একটু রসিকতা করে যায়।

বীর সাধকদ্বয়কে মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে উঠতে হয়। হাত পা ও মুখের অনাবৃত অংশে মশক স্পর্শে যে জ্বালা ধরে, বিরহের জ্বালার চেয়ে সে জ্বালা কিছু কম নয়।

রাত মনে হয় তখন আটটা হবে, খস্ খস্ করে একটা শব্দ এলো আর সেই শব্দটা মৃত গরুটার কাছ পর্য্যন্ত এসে থেমে গেল। দুই বন্ধুর স্নায়বিক কেন্দ্রে জেগে উঠল চেতনা।

অপূর্ব্বকুমার বন্দুক তুলে ধরে টর্চের বোতাম টিপলে। অন্ধকারের কালো পর্দা ভেদ করে ছুটলো আলোর তীর। আর সেই আলোতে বন্ধুদ্বয় দেখতে পেলো, মৃত গরুটার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বৃহৎ শেয়াল।

চোখে আলোর ধাঁধা কাটতেই শেয়ালটা খ্যাক খ্যাক শব্দ করে ছুটলো বনের মধ্যে, আর শঙ্করনাথ মোটা গলায় উচ্চারণ করলো—'হোপলেস'।

আলো নিভে গেল। আবার সুরু হল সাধনা। রাত প্রায় তখন ৯টা হবে সেই সময় ওদের কানে ভেসে এলো আবার জানোয়ারের পদশব্দ।

অপূর্ব্বকুমার ফিস ফিস করে বললে—শালার শেয়ালটা জ্বালালে। শঙ্করনাথ অপূর্ব্বকুমারের গায়ে একটা চাপ দিয়ে আলো জ্বালাবার সঙ্কেত করে। নিতান্ত অনিচ্ছা ভরে অপূর্ব্বকুমার টর্চ এর বোতাম টিপলে। সাদা আলোর মধ্যে দিয়ে সে দেখতে পেলো মাত্র কুড়ি হাত দূরে মৃত গরুটার উপর দীপ্ত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে জাফরনগরের বীর। অপূর্ব্বকুমারের সারা দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

সময়ের সমুদ্র হ'তে মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড ঝরে পড়ে! শঙ্করনাথের বন্দুকের দক্ষিণ নল হতে অগ্নি বর্ষণ হল—নিস্তব্ধ বনানীর মাঝখানে জেগে ওঠে বেমানান শব্দ।

অপূর্ব্বকুমারের হাতের আলো নিভে গেল। উত্তেজনায় ওদের স্নায়ুমণ্ডলীতে আক্ষেপ জেগেছে—তাই ওদের নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত তালে। গভীর অন্ধকারের মাঝে, বুকে এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে বসে আছে দু'জনে, কারও মুখ দিয়ে কথা সরে না। 

.

.

.

জাফরনগরের শের

মিহিরলাল চট্টোপাধ্যায়

....................................

বাঙালির শিকার স্মৃতি

সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা 



Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।