এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

তিন কুড়ি বছর পেরিয়ে গেল সেই বাড়িটা ছেড়ে চলে এসেছিলাম। জন্ম থেকে সেই বাড়িটাতে মোটামুটি থেকেছিলাম অনধিক ষোলো বছর। এখনও যদি কেউ জানতে চায়—'আপনার বাড়ি কোথায়?' কিছু না ভেবেই উত্তরটা দিয়ে ফেলি—বাড়ি কেওড়া গ্রামে। থানা ঝালকাঠি, জেলা বরিশাল।' অথচ, এই ঠিকানায় আমার অবস্থান ছিল বছর ষোলোর মাত্র। ষাটের দশকের তৃতীয় বছরে দেশ ছেড়ে এসেছিলাম পশ্চিমবাংলায়। তারপর সে লম্বা কথা। বাড়ি কোথায়, প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে যে ঠিকানাটা বলি, কালের চক্রান্তে তা এখন আর তেমনটি নেই। তখনও বাড়িটা কোথায়, এর উত্তর দিতে গিয়ে বলি, যেমন একটু আগে বললাম। কিন্তু যদিও গ্রামটা এবং বাড়িটা এখনও তেমনই পরিচয়ে আছে, লোকে চিনবেও। কিন্তু আসলে এখনকার পরিচয়—গ্রাম কেওড়া, থানা এবং জেলা ঝালকাঠি, বরিশাল বিভাগ, দেশটা বাংলাদেশ। যখন দেশটা জন্মশোধ ছেড়ে চলে এসেছিলাম, তখন ঠিকানা লেখা হতো, শ্রীযুক্ত অমুক, কেয়ার অফ শ্রীযুক্তবাবু অমুকচন্দ্র তমুক। গ্রাম কেওড়া, পোস্ট অফিস কেওড়া, থানা ঝালকাঠি, জেলা বরিশাল, পূর্ব পাকিস্তান।

ক্রমশ দেশটার অনেক পরিবর্তন হয়ে এখন নাম হয়েছে বাংলাদেশ অর্থাৎ এখন আর পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান নয়। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তথাপি বাড়ি কোথায় প্রশ্নের উত্তরটা এখনো বলি—'কেওড়া, বড়বাড়ি।' এই গ্রামে আমার যতদিন বসবাস, তার প্রায় সাড়ে চার গুণ সময় কেটেছে এই পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন স্থানে, একবার এঘাটে, একবার ওঘাটে। তার বেশিরভাগ স্থানেই অবস্থানটাকে বাড়ি বলে উল্লেখ করিনি কোনোদিন।

সর্বশেষ এখন যেখানে আছি সেটাকে বাড়ি বলি বটে, তবে তারও সেই মান্যতা নেই। আগেরগুলো সব 'বাসা'। এখনকারটাকে বাড়ি বলি, একটা আকাঙ্ক্ষা পুনর্নির্মাণ করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। বাল্যকালীন, বহুল প্রচলিত একটা রঙ্গগল্পের কথা মনে পড়ে। বাঙালেরা বাসা এবং বাড়ি দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে। বাসাতে, তাদের মতে পাখিরা থাকে। মানুষ থাকে বাড়িতে। পশ্চিমবাংলায়, বিশেষত কলকাতায় শব্দ দুটি সমার্থক। এক বাঙালকে জনৈক কলকাতাবাসী নাকি প্রশ্ন করেছিল—'আপনার বাসা কোথায়?' সেই বাঙাল ছিল কুলীন বরিশালি বাঙাল, যারা কোনো কথা সোজাভাবে বোঝে না। সে ভাবল, 'কলকাইত্যা লোকটা নিশ্চয়ই তাকে তুচ্ছভাবে পাখি বলে ভেবেছে। আবার এও ভাবল, পাখি যখন ভেবেছে, নিশ্চয়ই খুব কদর্য পাখিই ভেবে থাকবে। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই শকুন ভাবাই সম্ভব। এখন, বরিশালি জবানে 'শকুন' শব্দটির উচ্চারণ হচ্ছে 'হহুন'। সুতরাং 'বাসা কোথায়'—এই প্রশ্নের উত্তরে সে সরাসরি বলল, 'হহুন (শকুন) তোর বাফে (বাপে)।'

বাড়ি শব্দটার ডিনোটেশন এবং কনোটেশন ব্যাপারটা স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকার। ব্যাপারটা ক্ষুদ্রতা এবং ব্যাপকতার। গ্রামীণ যৌথ গৃহস্থালিতে যারা কোনোদিন বসবাস করেছে, তারাই বাড়ি কথাটার ব্যাপকতা বোঝে। বাসা জিনিসটা শহুরে, ক্ষুদ্রতা। সেটা যেন অনেকটা গর্তের মতো। বাইরের জগতের সঙ্গে তার একাত্মতা বোধে আসে না। যখন কেওড়ার বাড়ি চিরকালের মতো ছেড়ে এসেছিলাম, মনে হয়েছিল দুহাতের স্নেহের আগল থেকে যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেলাম। ওরকম একটা হাহাকারি-অনুভূতি এ জীবনে আর পেলাম না। ছন্নছাড়া হওয়ার এই অনুভূতিটা জীবনে যেন চিরস্থায়ী হয়ে রইল।
.
.
.
এপার বড়ো মাঘ মাস, ওপার বড়ো কুয়া
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী 
মুদ্রিত মূল্য : ২৭০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।