এক যে ছিল গ্রাম। ভূতে মারে ঢেলা

পড়ছি গড়বেতা ইস্কুলে, ক্লাস সিক্স থাকি উকিলবাবুর মেসে কখনও কখনও দু-চার দিনের ছুটিতে বাড়ি আসে বটে, সে নেহাতই আসা যাওয়া ছুটির আমেজ থাকে না গড়বেতা থেকে হুমগড় বারো তের মাইল রাস্তা বাসে আসতে সময় লাগে এক ঘণ্টা সারা দিনে দুটো বাস সকাল দশটায় ডাকগাড়ি, বিকেল পাঁচটায় ধর কোম্পানিরকল্পনা ডাকগাড়ি যায় গড়বেতা থেকে হুমগড় হয়ে গোয়ালতোড়, না-কি বাঁকুড়া জেলার সারেঙ্গা পর্যন্তও যায় কল্পনা আসে মেদিনীপুর শহর থেকে গড়বেতা হয়ে হুমগড় ডাকগাড়ি বিকেলের দিকে ফিরতি পথে হুমগড় হয়ে গড়বেতার দিকে চলে যায় কল্পনা থেকে যায় হুমগড়ে পরদিন সকালে আবার হুমগড় থেকে মেদিনীপুরের দিকে দৌড় দেয় হুমগড়ে বাস থেকে নামলেই তো আমাদের রাস্তা শেষ হয় না, কাঁচা রাস্তা দিয়ে মাইল দেড়েক হেঁটে গেলে তবে বাড়ি এতো হ্যাপা করে বাড়ি এসে আবার দু-এক দিন পরেই ফিরতে গেলে বাড়ি আসার মজাটাই থাকে না তাই গ্রীষ্মের আর পুজোর ছুটি দুটোই আমার আসল বাড়ি-আসা

এমনই এক গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এসেছি এক মাসেরও বেশি লম্বা ছুটি দিনের বেলায় বইপত্তরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না সন্ধে গড়িয়ে রাত্তির হওয়ার আগেই শুনশান হয়ে যায় গ্রাম দুধ-মুড়ি খেয়ে, হ্যারিকেন লন্ঠনের দম কমিয়ে শুয়ে পড়ে সবাই শহরে থেকে আমার অভ্যাসটা খারাপ হয়ে গেছে সবাই যখন ঘুমায় আমি তখন হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসি পড়া মানে পাঠশালার দুলে দুলে সুর করে সরব পড়া নয়, নীরবে একটার পর একটা অঙ্ক করে যাওয়া

আমাদের বাড়ির পশ্চিমের বাখুলে নতুন ঘর নতুন মানে আমার জন্মের আগেই, কিন্তু তখন ছিল টিনে ছাওয়া দুটো ঘর আর একটা লম্বা ঘেরা বারান্দা বছর কয়েক আগেই আমার চোখের সামনেই তার টিনের ছাউনি খুলে দিয়ে ঢালাই করা পাকা ছাদ হয়েছে নীচের দুটি ঘরের মাথায় উপরেও দুটি ঘর হয়েছে তাদের মাথায় নীচের ঘরের খুলে নেওয়া টিনের ছাউনি দুটি বসেছে কেবল লম্বা বারান্দাটির উপরে ন্যাড়া ছাদ দোতলায় ওঠার পাকা সিঁড়ি নেই, ছাদে কাঠের মই লাগিয়ে উঠতে হয় উপরের পূর্ব দিকের ঘরটিতে বড় বউদি তার কোলের দুটো মেয়েকে নিয়ে ঘুমোন পশ্চিম দিকের ঘরে নন্দীগ্রাম কলেজের মাস্টার, আমার খুড়তুতো বড়দা বাড়ি এলে তার বউ, মানে আমাদের নতুন বউদিকে নিয়ে ঘুমোন এই বউদির পরেও একজন বউদি এসেছেন কিন্তু ইনি সেই নতুন বউদিই থেকে গেছেন এই দাদা যখন নন্দীগ্রামে থাকেন তখন সেই ঘর কখনও ফাঁকা থাকে, কখনও বা দরকার মত কেউ এসে ঘুমোয় যেমন এই ছুটিতে বাবা আর আমি এই ঘরটায় রোজ ঘুমাচ্ছি

তো সেদিন সন্ধেবেলায় বাবা ঘরের ভিতরে ঘুমোচ্ছেন আর আমি ন্যাড়া ছাদে শতরঞ্চি পেতে হ্যারিকেনের আলোয় অঙ্কের বই আর খাতা নিয়ে অঙ্ক করে যাচ্ছি অঙ্ক করতে করতে বেশ মজে গেছি প্রতিটি অঙ্কের উত্তর মিলে যাচ্ছে আর আমি উৎসাহে ফুলে উঠছি একটা প্রশ্নমালা শেষ হয়ে গেল এক একটা প্রশ্নমালায় পঁচিশ তিরিশটা অঙ্ক থাকে যেটা শেষ করেলাম সেটা ছিল শতকরা অঙ্কের, পরেরটা সুদ কষার আমার এখন বইখাতা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে বাবার পাশে শুয়ে পড়ার কথা কিন্তু পরের প্রশ্নমালার আগে থাকা অনুশীলনীর কয়েকটা অঙ্ক দেখে নিয়ে আমার আত্মবিশ্বাস আর সাহস দুটোই এক লাফে বেড়ে গেল শুরু করে দিলাম সুদ কষার অঙ্ক এটা শেষ না করে উঠব না কিছুতেই পরের পর অঙ্ক করে যাচ্ছি, উত্তর মিলে যাচ্ছে আমি বুঁদ হয়ে এগিয়ে চলেছি চারদিক নিঝঝুম, কোথাও এক ফোঁটা আওয়াজও নেই সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমেছে কিনা, আমি কোথায় আছি, সেসবেরও খেয়াল নেই হঠাৎঢিস্‌’ করে একটা আওয়াজ! চমকে উঠে মুখ তুলে দেখি একটা পাথরের টুকরো শতরঞ্চির উপর পড়ে গড়াতে গড়াতে এসে আমার খোলা খাতার উপরে স্থির হলো সঙ্গে সঙ্গেই আমার হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে শুরু করেছে আমার মাথা নিমেষে অসাড় তবু অনৈচ্ছিক প্রতিবর্ত প্রক্রিয়ায় এক লাফে ঘরে ঢুকে বাবার পাশে শুয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে দিয়েছি বাবাকে ডাকতে চেষ্টা করছি, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না কতক্ষণ ওইভাবে শুয়েছিলাম জানি না যখন বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ কিছুটা কমেছে তখন মুখ দিয়ে কথা বেরোল বাবার গায়ে হাত দিয়ে আস্তে করে ঠেলা দিয়ে বললাম, --বাবা, কে ঢিল মারল আমার দিকে

ঘুম গলায় বাবা বললেন, --ঢিল? কোথায়?

--বাইরে

বাবা বিছানা ছেড়ে উঠলেন, বললেন, --চলো তো দেখি

বাবার পিছন পিছন ছাদে এলাম হ্যারিকেন জ্বলছে আমার অঙ্কের বই খাতা একই রকম খোলা পড়ে আছে কেবল ঢিলটাই নেই আচমকা পাওয়া ভয়টা ফিকে হতে শুরু করেছিল কিন্তু ঢিলের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সেটাকে বুকের মধ্যে চিরস্থায়ী করে দিল বাবা এদিক ওদিক দেখলেন, হ্যারিকেন তুলে রাস্তার দিকটা দেখার চেষ্টা করলেন আমরা বাদে আর কোনো জনপ্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হলো না বাবা বললেন, --কোথায় তোমার ঢিল! কী দেখতে কী দেখেছ! চলো শোবে চলো

বাবা কি আমাকে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করে সেই রহস্যের সমাধান করেছিলেন? তিনি অবশ্য ভূতে বিশ্বাস করতেন না, যদিও তিনিও এক জ্যোৎস্না রাতে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত চলে যাওয়া এক সাহেবকে দেখেছিলেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে সেই গল্প বলেও কারণ হিসাবে দায়ি করেছিলেন নিজের দৃষ্টিবিভ্রমকে আমার দেখাটাও কি তিনি দৃষ্টিবিভ্রম ভেবেছিলেন, না কি রহস্যের অন্য কোনো সমাধান ভেবেছিলেন, আমার জানা সম্ভব ছিল না কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি, আমার দেখায় কোনো ভুল ছিল না আমার বুকে চিরস্থায়ী হয়ে থাকা সেদিনের ভয়টা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রহস্যে পরিণত হয়েছিল পরিণত বয়সে এসে সেই রহস্যের সমাধানও খুঁজে পেয়েছিলাম কিন্তু বড়ো জটিল সেই রহস্য এইখানে প্রকাশ না করাই ভালো ভবিষ্যতে ইচ্ছে হলে না হয় একটা গল্প লিখব            

.......................................

এক যে ছিল গ্রাম

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

.......................................

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত


মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।