শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্যর উপন্যাস 'শেষ মৃত পাখি' পড়ে মতামত জানিয়েছেন তৃণময় সেন। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
...............................................................
#পাঠানুভূতি
#শেষ_মৃত_পাখি

"সে কি রাত্রির শেষ মৃত পাখি, যার স্মৃতি আঁচড়াল
মৃত্যুর ঘন ছায়ায় দেবযান
ভয়ের মতন মৃদুসঞ্চারী স্বপ্নের পিছু নিতে?
স্বপ্নের মত আয়ু চলে যায়, কখনো বা দ্রুত, কখনো বিলম্বিতে।"

লেখালেখিতে মোটেই মন বসে না আজকাল। কারণ অনেক কিছুই আছে, সেটা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান নাই বা করলাম। কিন্তু মন যে বসে না সেটাই মোদ্দা বা লাখ কথার এক কথা। তবে এই রিভিউ লেখারও কারণ একাধিক। তার মধ্যে একটা হলো প্রায় গায়ে পড়ে Sumona -র কাছ থেকে বইটা উপহার নিয়েছি। কথাও দিয়েছি মতামত জানাবো। তারপরেও পড়েটড়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। তাছাড়া রহস্য উপন্যাস আমি এর আগে পড়েছি বলে মনে পড়ে না। তাই মার্ডার মিস্ট্রি পড়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাইছিলাম।

গত কয়েক বছরে নানান জায়গায় শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্যের এই বই নিয়ে মাতামাতি চোখে পড়েছে। আকর্ষণ জেগেছে বইয়ের মনকাড়া প্রচ্ছদ দেখেও। রহস্য এমন একটা জঁর, যা একবার শুরু করলে নিজেই পাঠককে টেনে নিয়ে চলে। আর আমার যা দিনকাল চলছে, বই নিজে থেকে তার কাছে না নিলে আমি যে নিজে থেকে তাতে হাত দেব সেই অবস্থায় নেই। বাড়ি থেকে অফিস ২৫-৩০ মিনিটের রাস্তা, সেই সময়টাতেই বেশিরভাগ পড়া হয়েছে।

মেঘ পাহাড়ের স্নেহধন্য শৈল শহর দার্জিলিং। কান্না-হাসি-প্রেম-বিরহের মতো আর কত আবেগের একটাই নাম। বৃষ্টি। কিন্তু পাইন - ইউক্যালিপটাসের গা-বেয়ে যখন কুয়াশা নামে, রচিত হয় রহস্যের অদ্ভুত জগত, ঠিক তখন যেন মাকড়সার জালের মতো দুর্বোধ্য হেঁয়ালিতে আটকে পড়া মন খুঁজে চলে সেই রহস্যের সমাধান। যে রহস্যের গন্ধে দার্জিলিংয়ে এসেছেন সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক তনয়া ভট্টাচার্য।

২০১৭ সালের মার্চ মাসে দু'দিনের জন্য হলেও দার্জিলিংয়ে এমনই মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশার ত্র্যহস্পর্শ পেয়েছি বলে উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র দার্জিলিং ও তার স্বভাবের সাথে একাত্ম হতে পেরেছিলাম। বলাবাহুল্য মার্চ মাসেই আমাদের বিবাহবার্ষিকী। এবার আসি বইয়ের কথায়। তনয়া অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন পত্রিকায়। দার্জিলিং আসার উদ্দেশ্য সেই ধারাবাহিকের শেষ কাহিনীর সুলুকসন্ধান। বছর পঁয়তাল্লিশ আগে দার্জিলিংয়ের এক তরুণ সম্ভাবনাময় কবি অমিতাভ মিত্র খুন হন। সেই খুনে নাম জড়িয়ে পড়ে তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ চৌধুরীর, যিনি নিজেও একজন বিখ্যাত লেখক ও রহস্য ঔপন্যাসিক। যদিও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে অভিযোগ ধোপে টেকেনি এবং রহস্য অমীমাংসিতই থেকে যায়। এতো বছর পরে কি সেই রহস্যের জট খুলবে? তনয়া কি চিনতে পারবেন মেঘ-কুয়াশার আড়ালে থাকা আসল অপরাধীকে? সত্যিই কি খুন হয়েছিলেন অমিতাভ নাকি নিছক একটা ইলিউশান? ময়াল সাপের মতো ৪০২ পাতায় এঁকেবেঁকে চলে ঘটনার ঘনঘটা।

কাহিনী সত্তরের দশকের অস্থির সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন, নিরপরাধ যুবক-কিশোরদের নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদে সরব হয়েছে সেই সময়ের কবিদের কলম। প্রতিটা পর্বের শুরুতে আমরা পাই পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, কৃষ্ণা বসু, শম্ভূ রক্ষিত, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়দের মতো কবিদের কবিতার পঙক্তি। মূল গল্প তিনটি সুরে চলতে থাকে। বন্ধুস্থানীয় কবিদের প্রতি অমিতাভের লেখা চিঠি, তাঁরই খুনের ঘটনা আর আরও একটি মার্ডার মিস্ট্রি, যা মারা যাবার কিছুদিন আগে লেখা শুরু করেছিলেন অমিতাভ; কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তনয়া এই রহস্য উপন্যাস পড়েই খুনের মীমাংসায় পৌঁছতে পারবেন বলেই বিশ্বাস অরুণের, যিনি আবার নিজেই মূল অভিযুক্ত। আর প্রথম সাক্ষাতে খুন তিনিই করেছেন বলে দাবি করেন তনয়ার কাছে। যদিও সেটা মিথ্যে অপরাধের ভার সইতে না পারা এক ব্যক্তির আত্মসমর্পণ বলেই ধরেন তনয়া। 

বইটা পড়ার সময় পাঠক হিসাবে রহস্যের সমাধান খুঁজতে যেন নিজেও সামিল হয়ে যাচ্ছিলাম। উপন্যাসের মাঝপথে লুকিয়ে থাকা গোয়েন্দা মন বলছিল এই তো ধরেই ফেলেছি। টিভিতে ব্যোমকেশ, ফেলুদা বা হইচইয়ের একেনবাবু-তে যেরকম দেখায় আর কি...বেশ গর্বই হচ্ছিল। কিন্তু শেষ কুড়ি-পঁচিশ পাতায় অভাবনীয় এক সমাধান চোখের সামনে তুলে ধরেন লেখক। শেষ চমকে কার্যত বাকরুদ্ধ করে দেয় এই উপন্যাস। প্রতিশোধস্পৃহা মানুষকে কতটা হিংস্র করে দিতে পারে! জিঘাংসা কিভাবে বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে নির্দোষের জীবনে!

এর বেশি বলতে গেলে পড়ার আর্কষণ হারিয়ে যাবে। উপন্যাসের বেশ কিছু চরিত্র মনে থেকে যাবে, যেমন তনয়া, সিদ্ধার্থ, অরুণ, ড্যানিয়েল লামা আর অতি অবশ্যই অমিতাভ যিনি মরিয়াও প্রমাণ করেন যে......
.............................
মুদ্রিত মূল্য : ৫২০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
                

 

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।