এক যে ছিল গ্রাম। একের মধ্যে তিন

তার নাম, ধরে নেওয়া যাক, অমৃত কাছাকাছি বয়সের খোকন ও অমৃত একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের প্রথম ধাপগুলি একই চালে ঘষটাতে ঘষটাতে এগিয়ে চলছিল তখন পর্যন্ত তাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য বলতে খোকন যখন তালগাছের মাথায় উঠে কচি শাঁসওলা তালের কাঁদি কেটে নীচে ফেলছে, অমৃত তখন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সেগুলো গুছিয়ে রাখছে তবে আমার স্মৃতিতে অমৃতর অন্য একটা ছবিও অস্পষ্ট ভাসে

আমি তখন নেহাতই ছোটো, ফুটবলে লাথি মারার মতো পায়ের জোর হয়নি গ্রামেরই এক পোড়ো জমিতে এক ফুটবল-ম্যাচ আমাদের গ্রাম বনাম পাশের গ্রাম একটি মাত্র গাঁ থেকে এগারো জন খেলুড়ে জোটানো মুশকিল মাঠও ছোটো তাই সাত জনের দল খোকনের নেতৃত্বে আমাদের দলে অনিচ্ছুক অমৃতকে নিতে হয়েছে আমি দর্শক দেখছি অমৃত মাঠের ডান প্রান্তে সাইডলাইনের কাছে সারাটা সময় দাঁড়িয়েই আছে তাকে কেউ বল দিচ্ছে না, অন্যদের মতো ছোটাছুটি করে বল নেওয়ার আগ্রহও তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না খেলা যখন প্রায় শেষের মুখে তখন আচমকা বিপক্ষের পায়ে লেগে বল চলে এল অমৃতর পায়ে তাকে কেউ হিসেবের মধ্যে ধরেনি তখন অমৃতর সামনে কেবলমাত্র বিপক্ষের লেফট ব্যাক বল পায়ে চোঁ চোঁ দৌড় লাগাল অমৃত, লেফট ব্যাক সামনে আসতেই ছোট্ট ড্রিবলে তাকে এড়িয়ে গিয়েই শট নিল গোলে গোল সেই একমাত্র গোলে জিতে গেলাম আমরা খোকন বলল, আমি জানতাম বলেই অমতেকে জোর করে নামিয়েছিলম এখন ভাবি, সুযোগের সদ্ব্যবহার করার যে সহজাত প্রবণতা অমৃতর পরবর্তী জীবনে দেখা যাবে, সেদিন খেলার মাঠে ছিল তারই আভাস

অমৃত যখন অষ্টম শ্রেণিতে তখন তার সহোদর জ্যেষ্ঠাগ্রজ খানিক দূরের এক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন এবং অমৃতকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নিজের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন তারপর থেকেই শুরু হল তার প্রায় রূপকথার উত্থান উচ্চ মাধ্যমিকে সে হাই সেকেন্ড ডিভিশন পেল হ্যাঁ, সেকালে, মানে ১৯৬০-৬১ সালে এই নামে একটা ডিভিশন শিক্ষকদের মুখে মুখে চালু হয়ে গিয়েছিল কলা বিভাগে ৫৫ শতাংশের উপর নম্বর পেলে সেটা ফার্স্ট ডিভিশনের সমতুল বলেই গণ্য হত কলকাতার এক নামী কলেজে অর্থনীতিতে সাম্মানিক সহ স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে না করতেই ২৪ পরগনা জেলার এক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিতে বহাল হতে বিন্দুমাত্র হোঁচট খেতে হয়নি তাকে এই সময় একদিন কলকাতার রাস্তায় আকস্মিকভাবে তার দেখা হয়ে গেল পূর্বতন কলেজের অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে স্কুলে চাকরি নিয়েছে শুনে তিনি পরদিনই কলেজে ডেকে নিলেন তাকে ওই বিভাগের এক অধ্যাপক লিভ ভ্যাকেন্সি নিয়ে তখন বিদেশে সেই পদেই অস্থায়ী নিয়োগপত্র তার হাতে সেদিনই ধরিয়ে দিলেন বিভাগীয় প্রধান তিনি যেমনটি অনুমান করেছিলেন, সেইমতোই বিদেশবাসী অধ্যাপক আর ফিরলেন না সম্ভ্রান্ত কলেজের সেই পদটিতে স্থায়ী হয়ে গেল অমৃত

এই সফলতা অমৃতর অনন্য অর্জন নিঃসন্দেহে, বিশেষত বিদ্যালয়ের প্রথম ধাপগুলিতে যেহেতু তার মেধা নিয়ে কারোরই তেমন উঁচু ধারণা ছিল না অমৃত প্রমাণ করে ছেড়েছিল, যার যেটুকু সম্বলধৈর্য, অধ্যবসায় ও পাঠনিবেশ সহকারে স্থিত ধী হতে পারলে সেইটুকুকেই পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করে যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব এছাড়াও বিনীত আচরণ, শিক্ষক ও গুরুজনদেরকে নির্বিচারে মান্য করা, নিয়মানুসারী এবং বিতর্কাতীত থাকা ছিল তার স্বভাবের অন্তর্গত যা তার এগিয়ে চলার পথকে সুগম করেছিল

এসব অবশ্যই যে কোনো সমাজে তার কৃতিত্ব বলে গণ্য হবে কিন্তু যেকোনো মানুষের মনে দাগ রেখে যাবে এমনই প্রায় অসাধ্যসাধন কর্তব্য সে সম্পন্ন করেছিল তার বিবাহ-পরবর্তী জীবনে আমার কাছে সেটাই তার চরিত্রের উজ্জ্বলতর দিক প্রথমটা যদি হয় তার সফলতা, দ্বিতীয়টা তার জীবনের সার্থকতা

অমৃত যখন স্নাতকোত্তর ক্লাসে সবে ভর্তি হয়েছে, তখন তার অভিভাবকরা দেখেশুনে একটি গ্রাম্য কিশোরীর সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন সে তার গ্রামের কাছাকাছি একটি স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ের অপেক্ষাতেই ঘরে বসে ছিল অমৃতর সঙ্গে তার বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরেও তাকে বাপের বাড়িতেই থেকে যেতে হল, কারণ তার নবলব্ধ বরটি কলকাতায় নিজের হস্টেলে ফিরে যাওয়ার আগে তার মাথায় একটি ব্যতিক্রমী স্বপ্ন বুনে দিয়ে গেল

প্রায় বছর দুয়েক পরে স্নাতকোত্তর পরীক্ষাশেষে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েই সে ছুটল শ্বশুরবাড়িতে এই অবস্থায় সকলের স্বাভাবিক প্রত্যাশা হবে সে বৌকে নিয়ে মনোরম কোনো জায়গায় হপ্তাখানেক মধুচন্দ্রিমা যাপন করে ফিরে এসে নিজের কাজের জায়গায় সংসার পাতবে তারপর গৃহস্থালি ও সন্তানপালনের ভার বউয়ের ঘাড়ে ফেলে দিয়ে নিজের কর্মক্ষেত্রে উন্নতির চেষ্টায় মগ্ন হবে কিন্তু ব্যতিক্রমী অমৃত তার পরিবর্তে বৌকে নিয়ে নিকটবর্তী শহরের একটি গার্লস স্কুলে গিয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিল তারপর সেই স্কুলের বোর্ডিং-এ তাকে রাখার ব্যবস্থা করে ফিরে এল নিজের জায়গায়

দুটি বছর পড়াশুনার জগতের বাইরে থাকা সত্ত্বেও ছাত্রীনিবাসের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে অমৃতর তরুণী বধূ স্বামীর অনুপ্রেরণায় এবং নিজ স্বভাবগুণে পড়াশুনায় নিবিষ্ট হল স্বামীর সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হলে পড়াশুনার অগ্রগতির আলোচনাতেই কেটে যায় অল্প সময়ের সেই অমূল্য যৌথযাপন এই করতে করতেই যথাসময়ে সন্তোষজনকভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে গেল সে অমৃত সংসার-কর্তব্য পালনের জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে তাকে সেই শহরেরই একটি কলেজে ভর্তি করে দিল তিন বছর পরে বাংলায় সাম্মানিক সহ গ্র্যাজুয়েট স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় সংসার পাতল অমৃত ততদিনে সে নিজের কলেজে অধ্যাপনায় স্থায়ী হয়ে গেছে সংসার পাতলেও সহধর্মিণীর শিক্ষা সেখানেই থেমে গেল না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং কিছুদিন পর ২৪ পরগণার একটি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি অর্জন করার পর সম্পূর্ণ হল অমৃতর তাকে প্রকৃত সহধর্মিণী করার ব্রত

একটি স্কুল-ড্রপআউট গ্রাম্য মেয়েকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় এই উচ্চতায় নিয়ে আসতে কী ধরনের মানসিকতার প্রয়োজন হয় একবার ভাবুন তো; বিশেষত সে যদি হয় তার নবোঢ়া বধূ বাঙালির ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম দৃষ্টান্ত খুব বেশি পাওয়া যাবে না যেখানে একজন স্বামী একইসঙ্গে পিতার যত্নে, প্রেমিকের ভালবাসায় এবং স্বামীর কর্তব্যপরায়ণতায় অসীম সংযম ও ধৈর্য নিয়ে স্ত্রীটিকে নিজের উপযুক্ত করে গড়ে নিয়েছেন দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা অনেকের মাথায় আসতে পারে তবে তাঁরা দুজনেই ছিলেন অসাধারণ মানুষ সমাজ-সংস্কারক হিসাবে নারীজাতির অগ্রগতি ছিল তাদের জীবনের অন্যতম প্রধান এক লক্ষ্য কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে আমার সারা জীবনে অমৃত-তুল্য দ্বিতীয় কোনো স্বামীকে দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়নি আমার স্মৃতির ভাঁড়ারে বাস্তবিকই এ এক অমৃতকণা

.......................................

এক যে ছিল গ্রাম

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

.......................................

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত


মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।