এক যে ছিল গ্রাম। গুপ্তধন ও গোঁসাঘর
গত শতকের পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকের কথা। তখন বেসরকারি উদ্যোগে দু-চারটে ব্যাঙ্ক মফস্বল শহরে শাখা খুললেও, তাদের লালবাতি জ্বালানোর গৌরবময় অতীত রেকর্ড স্মরণে রেখে গ্রামীণ অবস্থাপন্নেরা তাদের চৌকাঠ মাড়াতেন না। তখন অবশ্য গ্রামাঞ্চলে কাঁচা টাকাপয়সার চলাচল বিশেষ ছিল না। শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্য হত ধান। সেই ধান বা চালের বিনিময়ে সাধারণ গ্রামবাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় নুন-তেল বা ন্যূনতম বসনটুকু সংগ্রহ করত। তার মধ্যেই কোনো কোনো গ্রামে দু-তিনশো বিঘে জমির অধিকারী দু-একটি অবস্থাপন্ন পরিবার ছিল। ষাটের দশক থেকে তাদের ‘জোতদার’ বলে ডাকা হতে থাকে। কালক্রমে শব্দটি ঘৃণ্য গালাগালির ব্যঞ্জনা পায়। তবে পেট পুরে ডালভাত খাওয়া এবং বাধ্যতামূলক কায়িক শ্রম থেকে রেহাই পাওয়া ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে তাদের জীবনযাপনের মান আর পাঁচজন গ্রামীণ মানুষের থেকে কিছু উঁচু ছিল না। উদ্বৃত্ত শস্য বিক্রি করে তাদের হাতে কাঁচা পয়সা জমত। সেই পয়সা জমিয়ে রাখার জন্যে তাদের নিজস্ব ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ছিল। জমানো অর্থ সোনার মোহর বা রুপোর টাকায় রূপান্তরিত করে ধাতুপাত্রে রেখে সেটির মুখ গালা দিয়ে বন্ধ করে বাখুলের বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে রাখা হত। সে জায়গার হদিশ সাধারণত বাড়ির কর্তাই কেবল জানতেন। তাঁর জীবিতকালে সেটি তুলে নিয়ে খরচ করতে না হলে মৃত্যুর আগে সেই অ্যাকাউন্টের হদিশ তিনি তাঁর প্রিয়তম ব্যক্তিকে জানিয়ে যেতেন। অনেক সময় হত কি – বার্ধক্যের কারণে কর্তা নিজেই ভুলে যেতেন কোনো অ্যাকাউন্টের হদিশ বা বিনা নোটিসে যমরাজ তাঁকে ওপারে তুলে নিয়ে যেতেন। তখন তিনি সেই অ্যাকাউন্টটি দানপত্র করে যাওয়ার সুযোগ পেতেন না, সেটি গুপ্তধনের মর্যাদা পেয়ে যেত। এবার কাহিনি –
এক গ্রামে এক বিশাল একান্নবর্তী
জোতদার-পরিবার। একটা রান্নাঘরে রান্না-খাওয়ার সংকুলান হচ্ছে না বলে
পুরনো রান্নাঘরের পাশেই আর একটি রান্নাঘরের ভিত খোঁড়া হচ্ছে। মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালের ঘর হবে, হাত তিনেক খুঁড়লেই যথেষ্ট। দু’জন মজুর ভিত খুঁড়ছে, তাদের কাজের
তদারকের দায়িত্বে সিতাংশু। সিতাংশু
বাড়ির মেজ কর্তার কলেজ-পড়ুয়া মেজ ছেলে। এখন
কলেজে ছুটি চলছে।
হাত দুয়েক খোঁড়া হয়েছে, হঠাৎ এক মজুরের কোদালের কোপে ঠং করে
আওয়াজ। সিতাংশু ছুটে এসে দেখে সেই কোপানো
জায়গায় কিছু একটা চকচক করছে। চটজলদি
খানিক মাটি নিয়ে সেটা চাপা দিল সে। মজুর
দুটিকে বলল, – একটু জিরিয়ে লাও গো তোমরা, পুকুরে হাতমুখ ধুয়ে বরং জলখাবারটা
খেয়ে লাও গে’ রান্নাঘরের দাওয়ায় খুড়িমার কাছে।
মজুররা কোদাল রেখে চলে
যেতেই দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল সিতাংশু।
দোতলার একটি ঘরে সিতাংশুর
স্বর্গীয় জ্যাঠার একমাত্র ছেলে পঞ্চানন এবং তার স্ত্রী একটি নাবালিকা কন্যা ও একটি
নাবালক পুত্র নিয়ে থাকে।
দ্বিতীয় ঘরটিতে থাকেন
তার বিধবা মা, যদিও দিনের সমস্ত সময়টাই তাঁর কাটে নীচের রান্নাঘরে। ওপরের যে ঘরটিতে সে থাকে, ঠিক তার নীচে একতলায় থাকেন
পরিবারের জ্যেষ্ঠতমা সদস্যা সিতাংশু-পঞ্চানন ইত্যাদির নব্বই বছর
বয়সি পিতামহী।
সিতাংশুর নিজের তিন ভাই, তার কাকার চার ছেলে
– সব মিলিয়ে তারা মোট নয় ভাই। কিন্তু সে পঞ্চাননের ন্যাওটা।
একটু পরেই পঞ্চানন তরতর
করে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে, পেছনে সিতাংশু। দুই
ভাই নিজেদের হাতে কোদাল তুলে নিয়ে অতি সন্তর্পণে ভিতের গর্ত থেকে বের করে ফেলল একটি
বড়সড় কাঁসার ঘটি।
সেটি নিয়ে তড়িঘড়ি করে
পঞ্চানন উঠে গেল দোতলায়।
সিতাংশুর খুড়িমা অর্থাৎ
সে-বাড়ির ছোটগিন্নি
অতি বুদ্ধিমতি মহিলা। তাঁর
কর্তা তাঁর শাশুড়ির কনিষ্ঠ পুত্র। অপত্য
স্নেহেও পক্ষপাত থাকে আর সাধারণত কনিষ্ঠ সন্তানের দিকেই সেটা বেশি ঝুঁকে থাকে। পতির সৌজন্যে তিনিও শাশুড়ির কাছের মানুষ। তিনি মজুরদের জলখাবারের মুড়ি-লংকা-পেঁয়াজ দিতে গিয়েই কিছু একটা আন্দাজ পেয়ে গেলেন। খাবার দিয়েই সটান গিয়ে ঢুকলেন শাশুড়ির ঘরে।
খানিক পরেই দেখা গেল কোমরে
সাদা থানের আঁচল গুঁজতে গুঁজতে বৃদ্ধা কর্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে টরটর করে চলেছেন অকুস্থলের
দিকে। গিয়ে দেখেন সব ভো-ভাঁ। মজুররা তখনও কাজে ফেরেনি, সিতাংশু খোঁড়া-ভিতের দিকে উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে। যা বোঝার নিমেষে বুঝে নিলেন তিনি, চকিতে ফিরে এলেন দোতলার সিঁড়ির
কাছে।
উপরে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ
কণ্ঠে চেঁচিয়ে ডাকলেন, – পচাই(পঞ্চাননের ডাকনাম)! পচাই এসে
সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াল।
শুরু হল কুরুক্ষেত্র! একপক্ষে নবতিপর দুধে-আলতা রঙের লোলচর্ম মহিলা, অন্যপক্ষে দীর্ঘদেহী,
কৃষ্ণবর্ণ, ত্রিশবর্ষীয় এক তরুণ। পরিবারের বাকি সব উপস্থিত সদস্য উদাসীন দর্শক। যুদ্ধের অস্ত্র বলতে বাক্যবাণ। ওই গুপ্ত সম্পত্তির প্রকৃত উত্তরাধিকারী কে
তাই নিয়ে বাদানুবাদ।
দেখা গেল বৃদ্ধার সংহিতা
এবং তাঁর নাতির সংহিতার মধ্যে মেরু-দূরত্বের ব্যবধান। শেষ পর্যন্ত সংহিতা শিকেয় তুলে এই একান্নবর্তী
পরিবারে কে ত্যাগী, বঞ্চিত আর কেই বা লাভবান এই নিয়ে তীক্ষ্ণ গোলাগুলি বর্ষিত হচ্ছে উপর থেকে। ততক্ষণে বৃদ্ধার দম ফুরিয়েছে। তিনি অসহায় ক্রোধ ও ক্লান্তিতে থরথর করে কাঁপছেন। তাঁর দুই পুত্র, তাঁরাও বৃদ্ধ, মায়ের দুই হাত ধরে কোমল স্বরে ‘মা মা’ বলে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। এর পর কী হবে তা যেন সবাই জানতেন। কর্ত্রীর ছোটো বৌমা দ্রুত হাতে শাশুড়ির জামাকাপড়, জপের মালা ইত্যাদি গুছিয়ে
একটি ঝোলায় ভরছেন।
বড়ো বৌমা অর্থাৎ পঞ্চাননের
মা অন্য একটি ঝোলায় আতপ চাল,
ডাল, চিড়ে, খই, গুড় ইত্যাদি গুছিয়ে রাখছেন। কর্ত্রী চোখ ফিরিয়েই হাতের সামনে পেয়ে গেলেন তাঁর কনিষ্ঠ নাতিকে। সে নেহাতই আট বছরের এক বালক। হাঁ করে এতক্ষণ এই বিচিত্র যুদ্ধ গিলছিল। ছেলেদের হাত ছাড়িয়ে খপ করে সেই বালকের হাত
ধরলেন বৃদ্ধা। –এই সংসার আমি চিরতরে তেয়াগ করলাম- কাঁপা কাঁপা স্বরে
এই বাক্য ভাসিয়ে দিয়ে বালকের হাত ধরে টরটর করে পথে নামলেন তিনি। বালকও বুঝল, ছাড়ান নাই। এখন বেশ কিছুদিন তাকে বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরের
বাগানবাড়িতে থাকতে হবে।
সবাই বলে ঠাকুরানীর গোঁসাঘর। মনটা তার নেচেই উঠল। উইঢিপিময় সেই বাড়ির মাটির দেওয়াল। তার পাশে তাল গাছে ঘেরা আম-জাম-কাঁঠালের
বাগান।
দু’ পা হাঁটলেই লাল মাটিতে শালের
জঙ্গল।
দূরে দূরে দুটো একটা
সাঁওতাল গ্রাম।
আর একটা বিশাল ফুটবল
খেলার মাঠ। সারা দিন গাছে গাছে কাটিয়ে বিকেলে
সাঁওতাল ছেলেদের সঙ্গে খেলা,
সন্ধেবেলায় ঘন দুধ আর গুড় দিয়ে চিড়ে খেয়ে ঠাকুরানীর সঙ্গে শুয়ে শুয়ে
রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনা। পাঠশালা, পণ্ডিতমশায়দের সাধ্য নেই সেখানে গিয়ে ঢোকে। পিছনে মুখ ফিরিয়ে সে শুধু একবার দেখে নিল দুই
কাঁধে দুই ঝোলা নিয়ে খানিক দূরত্ব রেখে কাকু তাদের পিছন পিছন আসছেন কি না। সে ঠিকই জানে বাড়ির একটি মুনিষ একটি দুগ্ধবতী
গাই নিয়ে সন্ধের মধ্যে বাগানবাড়িতে পৌঁছে যাবে ঠিক।
.......................................
এক যে ছিল গ্রাম
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
.......................................
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment