এক যে ছিল গ্রাম। শচীনন্দনের ঘোড়া
‘গরিবের ঘোড়া রোগ’- বাগধারাটি কাউকে বিশেষ আর ব্যবহার করতে দেখি-ও না, শুনি-ও না। কারণ অতি সরল। গরিব এবং ঘোড়া – দুজনেই কোয়ান্টাম কণার মতো কার্যকারণ ছাড়াই একযোগে অদৃশ্য হয়েছে। আমাদের আবার বিজ্ঞানে অনাস্থা, বিশেষ করে আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীই যখন কোয়ান্টাম বিদ্যার অনির্দেশ্য তত্ত্বে আস্থা রাখতে পারেননি, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের এই অকারণ যোগসূত্রে বিশ্বাস রাখার প্রশ্নই নেই। আমরা বরং স্বরচিত ইতিহাস ঘেঁটে গরিব-ঘোড়ার উধাওযোগ আবিষ্কার করার চেষ্টা করি।
ইন্দিরাজির রাজত্বকালে তিনি ‘গরিবি হঠাও’ অভিযান শুরু করেছিলেন, সেটা শেষ করলেন বর্তমান রাজাধিরাজ মোদীজি। কাজেই দেশে আর গরিব থাকার কোনো উপায়ই রইল না। ঘোড়াদের ব্যাপারটা আলাদা। তাদের রমরমা ছিল ইংরাজদের রাজত্বে। মোটরগাড়ি আবিষ্কারের পরেও ইংরাজদের অশ্বপ্রীতিতে তেমন ভাটা পড়েনি। বাঘা বাঘা সব সাহেবদের ছিল হরেক রকমের অশ্বতেজা গাড়ি। তাদের নামের কী বাহার! দিশি জমিদাররাও তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতেন। দেশিবিদেশি সেসব গাড়ির নাম জানতে হলে গুগল পণ্ডিতের দ্বারস্থ হউন। সেযুগের কথা জানতে এখন আর কষ্ট করে বইয়ের পাতা ওলটানোর দরকার নেই। সাবেক পণ্ডিতদের দিন গিয়াছে, এখন পণ্ডিত একজনই – গুগল পণ্ডিত। হ্যাঁ, যা বলছিলাম – রেসের ময়দানে দেশিবিদেশি সাহেবদের ভাগ্যবহ বিলাস ছিল ঘোড়দৌড়। ঘোড়সওয়ার পুলিশ তখন ময়দান দাপিয়ে বেড়াত। ইংরেজ-বিদায় আসন্ন দেখে মোটরগাড়ি দ্রুত রাস্তার দখল নিতে শুরু করে। তবে ঘোড়দৌড়ের জৌলুস এই সেদিনও ছিল। উত্তরবঙ্গ থেকে একটা বাঙাল ছেলে কলকাতায় এসে হাইকোর্ট না দেখে রেসের ময়দানে ঢুকে পড়েছিল। তারপরেই শুরু হল তার ‘দৌড়’। তার সেই দৌড় এখনও জারি। মধ্যিখানে বোধহয় দম নিতে বছর খানেক থেমেছিল, তারপর আবার শুরু হয়েছে বুড়ো ঘোড়ার দৌড়। ঘোড়দৌড় এখনও চালু আছে কিনা জানি না, সর্বজ্ঞানী সমাজ-মাধ্যমে এই নিয়ে টুঁ শব্দটি নেই দেখে সন্দেহ হয়। নিশ্চিত হতে হলে গুগল পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করুন। তবে কলকাতা এখনও একেবারে ঘোড়াশূন্য হয়ে যায়নি। ময়দানে গেলে দু-চারটে ছ্যাকড়া-গাড়ির ঘোড়া দেখা যায়, এমনকি ঘোড়ায় চাপা পুলিশও।
তেমনি একেবারে প্রান্তিক গ্রামগুলোয় দু-চারটে গরিবের সন্ধান এখনও পেতে পারেন। তারা আবার খেতে না পেলে মারাও যায়। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে অশ্বদর্শনের কথা ভুলে যান। জমিদাররাও গেছে, বেবাক গ্রামবাসী ঘোড়া কেমন দেখতে হয় তাও ভুলে গেছে। এটা আজকের কথা নয়, পাঁচ যুগ আগে থেকেই তাদের এই অবস্থা। সে হিসেবে আমাদের ভাগ্যবান বলতে হয়। আমরা আমাদের ছেলেবেলায় শুধু দেখা নয়, তার পিঠেও চড়েছি দেদার। কারণ, আমাদের গাঁয়ে জন্ম নিয়েছিলেন শচীনন্দন।
কথা হচ্ছিল গরিব এবং ঘোড়া বিষয়ে। তো এই শচীনন্দন এই দুই প্রাণীকে এক সূত্রে বাঁধতে পেরেছিলেন। সেই গল্পটি শোনাব বলেই এইসব অবান্তর পাঁয়তারা! শচীনন্দনের, ঠিক ঘোড়া নয়, ঘোড়া কেনার রোগ ছিল। আর তিনি গরিবও ছিলেন না ঠিকঠাক। তবু তিনিই একদিন হয়ে উঠলেন এই বাগধারার আদর্শ দৃষ্টান্ত।
আমি যখন একটু বড়ো হয়ে গাছে-টাছে উঠতে শিখলাম, তখন অবশ্য তিনি আর আমাদের গ্রামে বাস করেন না; মাইল দুয়েক দূরে জঙ্গলের ধারে উদমা মাঠে দোতলা মাটির বাড়ি বানিয়ে সেখানেই থাকেন। প্রায় জোতদার ধরনের সম্পন্ন চাষির একমাত্র সন্তান ছিলেন শচীনন্দন। বেশ দীর্ঘকায় সুপুরুষ যুবক। কিন্তু বাবা চোখ বুজতেই তিনি ঘোড়ার খপ্পরে পড়ে গেলেন। একটা করে কুলীন জাতের ঘোড়া কেনেন, মাস কয়েক বিনা কাজে এখানে ওখানে টগবগ করে ছুটে বেড়ান, তারপর সেটাকে জলের দরে বেচে দিয়ে আরেকটা কেনেন। বাবা মারা যাওয়ার আগে তাঁর একটা বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঘোড়ার ব্যাপারে যেমন, তেমনি এ ব্যাপারেও শচীনন্দন বিচিত্রগামী ছিলেন। বহু রকম কথা হাওয়ায় ভেসে বেড়াত, পাঠশালার ছাত্র হলেও সেসব কথার মর্ম বুঝতে আমার তেমন অসুবিধে হত না। তবে সেগুলো উপভোগ করার মতো চিত্তবৃত্তির স্ফুরণ তখনও হয়নি। আমাকে টানত তাঁর ঘোড়াটি। ততদিনে শচীনন্দনের জমিজমার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই, চেহারার জৌলুসও গেছে, তার সঙ্গে ক্রমাবনতি হয়েছে তাঁর ঘোড়া এবং অন্যতর সঙ্গীর কৌলীন্যে। তাঁর বর্তমান সওয়ারের সহিস নেই, দানাপানি-দলাইমালাই নেই। এমনকি তার পিঠে সওয়ারি হতেও দেখা যায় না তাঁকে। সে দিব্যি নিজের মতো মাঠে চরে বেড়ায় সারাদিন। সেই মওকায় যেসব বালক গাছ-চড়ায় সিদ্ধপদ, তারা একটি ছিপটি হাতে লাফ দিয়ে তার পিঠে উঠে বসত। আমিও তাদের মধ্যে একজন। লাগামের বদলে ঘোড়ার কেশর মুঠোয় ধরে ছিপটি দিয়ে তার পাছায় মারতে মারতে তাকে ছোটানোর চেষ্টা করে যেতাম। কিন্তু প্রায়ই ব্যর্থ হত আমাদের উদ্যম। সেই ঘোড়ার ছোটার ইচ্ছে বা ক্ষমতা একেবারেই ছিল না। জোড়া পায়ের বদলে চার পায়ে চলার ফলে আমাদের জঙ্ঘায় একটা বিচ্ছিরি ধরনের ব্যথা হত। পরদিন ইস্কুলে গিয়ে ঘোড়ার রচনা লিখতে হলে শুরু করতাম, ‘ঘোড়া অতি নিরীহ প্রাণী’ বলে এবং শেষ করতাম ‘ঘোড়ায় চড়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ’ বলে। আমরা যখন বড়ো ইস্কুলে তখন বোঝা গেল শচীনন্দন সত্যিকারের গরিব হয়েছেন। ভাগ্যি ভালো যে তার স্ত্রীর ছেলেপুলে হয়নি, তিনি প্রায় ভিক্ষা করে দুজনের খাবার জোগাড় করতেন। ততদিনে কী একটা অসুখে শচীনন্দন শয্যাশায়ী, চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। তার শেষ ঘোড়াটিও প্রায় পঙ্গু, চরে বেড়ানোর সাধ্য তারও নেই। একই দিনে তাদের মৃত্যু হল। গ্রামের লোকেরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে একই চিতায় শচীনন্দন এবং তাঁর ঘোড়াটিকে শুইয়ে দিল।
এইভাবেই শচীনন্দন গরিব ও ঘোড়াকে এক সূত্রে বেঁধে বাংলা ভাষার মান রক্ষা করে আমার স্মৃতিতে অবিস্মরণীয় হয়ে থেকে গেলেন।
Comments
Post a Comment