এক যে ছিল গ্রাম। ছায়ের হেঁশেল

তিনি ছিলেন আমার জ্যাঠাইমা কেন আমরা ভাইবোনেরা সবাই তাকেছাবলতাম জানি না এটা যে জানার বিষয় তেমনটা কোনোদিন মাথায় আসেনি ছোটোখাটো রোগাপাতলা মানুষটি, গায়ের রঙ চাপা, পাতলা ঠোঁট, পরনে থান, কথা খুব কম বলেন, হাসি দেখা যায় কদাচিৎ নীরবে বাড়ির এতগুলো লোকের, ছেলেপুলের খাওয়াদাওয়া দেখভাল করেন, তাঁরছাহওয়াটা দিনরাত্রির মতোই স্বাভাবিক আমার ভাইপো-ভাইঝিরা অবশ্য তাঁকেদাবলে এই সামান্য ধ্বনিপরিবর্তনে একাক্ষরের মায়া কম পড়ে না এতটুকু

ছায়ের কথা বলতে গেলে তাঁর শাশুড়ির কথা বলতেই হয় তিনি আমাদের নবতিপরদিদিগোঁসাই’, আমার ভাইপো-ভাইঝিদেরধনমা জমিদার-কন্যা দুধে-আলতা গায়ের রঙ আমি অবশ্য জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তাঁকে দেখছি লোলচর্ম, গলার স্বর সামান্য কাঁপা-কাঁপা কিন্তু অখণ্ড প্রতাপ বাবা এবং কাকুর যথেষ্ট বয়স, বৃদ্ধইতবুও তাঁর সঙ্গে গলা নামিয়ে কথা বলেন তাঁর তিন বৌমা শাশুড়ির তীক্ষ্ণ নজরে তটস্থ হয়ে থাকেন অবশ্য সকালের কয়েক ঘণ্টা মাত্র তাঁর নজরদারি চলে দুপুরের খাওয়া হলে সারা বিকেল তিনি সুর করে রামায়ণ কিংবা মহাভারত পাঠ করেন পুণ্যলোভী শ্রোতাও থাকে দু-চার জন সন্ধেবেলায় খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার পর দ্বিতীয়বার তাঁকে রামায়ণ-মহাভারতের ঝাঁপি খুলতে হয় তখন আর কৃত্তিবাস বা কাশীরাম নয়, তিনি নিজের ভাষায় তাঁর কোলের কাছে শোয়াবসা খুদেদের রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি শোনান আমি আর আমার চেয়ে দু-এক বছরের ছোটো এক ভাইঝিএই দুই পাঠশালি ছিলাম এই কাহিনির আগ্রহী শ্রোতা আমার পূর্বসূরিদের মধ্যেও নিশ্চয় কেউ কেউ এরকম আগ্রহী ছিল কিন্তু আমি বলছি আমার সময়ের কথা দিদিগোঁসাই-এর অনেক নাতিনাতনির মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আমিই একা তখন পড়ে ছিলাম ভাইপোভাইঝিদের দলে

আমাদের ছা দিদিগোঁসাইয়ের বড়ো বৌমা তিনি যে শাশুড়ির প্রসন্ন দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত ছিলেন তার পেছনে একটা মর্মান্তিক ঘটনা আছে আমার জন্মের অনেক আগের সেই ঘটনা এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর ছায়ের পর পর দুটি কি তিনটি সন্তান হয় গর্ভেই নষ্ট হয়ে যায়, নয়তো ভূমিষ্ঠ হয়েই মারা যায় পরেরটি এক পুত্রসন্তান, ছায়ের দুর্ভাগ্য কাটিয়ে বড়ো হয়ে ওঠে কিন্তু সেই বালকের বয়স যখন সবে পাঁচ বছর, সর্ব অর্থে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই সে পিতৃহীন হল

মাঠে ধান রোয়া চলছিল দিদিগোঁসাই-এর বড়ো ছেলে, অর্থাৎ আমার জ্যাঠাগোঁসাই মুনিষদের জন্যে জলখাবারের মুড়ি নিয়ে গিয়ে সবে মাঠের আলে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন আকাশে ভারী মেঘ ঝুলে ছিল কিন্তু বৃষ্টি তখনও ঠিক নামেনি জ্যাঠাগোঁসাইয়ের এক হাতে মুড়িভর্তি বেতেবোনা ঝুড়ি, অন্য হাতে ছাতা দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি্র আভাস পেয়ে আলের উপর ঝুড়ি নামিয়ে ছাতা খুলতে যাবেন সহসা ঝলসে উঠল চরাচর মুনিষরা রোয়া বন্ধ করে মুড়ি নিতে উঠে আসছিল একই সঙ্গে সবাই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাঠে বাজের কানফাটানো শব্দ আর এতগুলো লোককে পড়ে যেতে দেখে দূর মাঠের মানুষজন ছুটে এল চোখেমুখে জল দিতে মুনিষরা একটু পরেই উঠে বসে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিন্তু জ্যাঠাগোঁসাই নিঃস্পন্দ তাঁর শরীর যেন পোড়াকাঠ

মাত্র তিরিশ বছর বয়সের জ্যেষ্ঠ সন্তানের এমন ভয়াল মৃত্যুতে শোকাহত দাদাগোঁসাই শয্যা নিলেন, সেটাই হয়ে উঠল তাঁর শেষ শয্যা আর এই জোড়া বিপর্যয়ের জন্য শোকক্লিষ্ট দিদিগোঁসাইয়ের চোখে দায়ি হয়ে রইলেন তেইশ বছরে আচমকা বিধবা হয়ে যাওয়া জ্যাঠাইমা, আমাদের বেচারা ছা অতীতের সেই শোকের ছায়া থেকে আমরা ছোটোরা স্বভাবতই মুক্ত ছিলাম দিদিগোঁসাই রান্নাঘরে ঢুকতেন না তিনবেলাই খাবার সাজিয়ে খুড়িমার হাতে তাঁর শোবার ঘরে পাঠিয়ে দিতেন ছা বড়ো বউ হিসাবে মূল রান্নাঘরের দায়িত্ব পড়েছিল ছায়ের উপর মা ও খুড়িমা রান্নাঘরের বহির্বিভাগে, অর্থাৎ উঠোনে ধান সেদ্ধ, বারান্দায় মুড়ি ভাজা, ঢেঁকিশালে ধান বা চিড়ে কোটায় ব্যস্ত থাকতেন এসব কর্মবণ্টন অবশ্যই দিদি গোঁসাইয়ের নির্দেশমতো হত অতশত বোঝার বয়স হয়নি তখন, কেবল জানতাম খিদে পেলে ছায়ের কাছে গিয়ে মুখ দেখাতে হবে আর রান্নাঘরের উল্টো দিকে হামারচালায় যে ভাঁড়ার ঘর, যেখানে মকর সংক্রান্তির জন্যে আনা নারকেল, কিংবা কুটুমবাড়ি থেকে আসা মিঠাইয়ের হাঁড়ি রাখা থাকে, তার চাবিটি ছায়ের আঁচলেই বাঁধা আছে

ছায়ের একটি, মায়ের চারটি আর খুড়িমার চারটি, বাড়ির মোট নটি ছেলের মধ্যে চারটি ছেলের বউ ততদিনে এসে গেছে তাদের দু-এক জন আঁতুড় বা বাপের বাড়িতে গেলেও বাকিরা ছায়ের হেঁসেলে নবিশি করে নিরামিষ হেঁসেল কারণ বাড়ির ছেলেদের নিরামিষ আহারই কুলপ্রথা মেয়ে-বউরা মাছ-শামুক, হাঁসের ডিম-মাংস খায় বটে কিন্তু আলেকালে বিশেষত বাড়ির বিয়েওলা মেয়েরা বাপের বাড়ি এলে হইহই-হিহি করতে করতে নিজেরাই গোয়ালের পাশের চালায় সেসব রাঁধাবাড়া করে খায় অথবা পুকুর গাবানো হলে অনেকদিন ধরে মাছের ঝোল থেকে টক অব্দি হরেক রকমের মোচ্ছব চলে তবে সেসব চলে ওই গোয়াল চালাতেই

ছায়ের হেঁসেল নৈকষ্য নিরামিষ হলেও বিচিত্র তরকারির ব্যাপারটা সরলসোজা; বিরি কলাইয়ের ডাল আর যখন যে সবজি বাড়ির ক্ষেতে ফলে তারই তিনটে পদ সেদ্ধ, ভাজা আর চচ্চড়ি শেষ পাতে ভাতে খাওয়ার ঘন দুধ আর ছায়ের নিজের হাতে করা গ্রীষ্মের সঞ্চয় আমসির পাতলা চাটনি বৈচিত্র্য কেবল ভাতের বেলায় তিন রকমের ভাত একটি হাঁড়ির ভাত শক্ত শক্ত, ঝরঝরে ছায়ের নিজের ছেলে আমার যে দাদাটি, তিনি একটা ভাতের সঙ্গে আর একটি লেগে থাকলে খাবেন না অন্য একটি হাঁড়িতে মণ্ডপাকানো অতি-সেদ্ধ ভাত ডাল দিয়ে মেখে নিলে চিবোনোর ঝামেলা নেই, সড়াৎ করে পেটের ভেতর ঢুকে যায় এই ভাত না হলে আমার যে দাদাটি ছায়ের মেজ জায়ের এবং এই বাড়ির প্রথম সন্তান, তিনি খাবেন না এসব কিছু অভিনব নয়, অদ্ভুততম ভাত খাওয়া ছিল ছায়ের ছোটো দেওর, আমার কাকুর আমি এখনও সেই ছবিটি পরিষ্কার দেখতে পাইকাঠের উনুনে একটি ছোটো পেতলের হাঁড়িতে ভাত ফুটছে; ছা উনুনের পাশে একটি লম্বা হাতার ডাবু নিয়ে পিঁড়ির উপর বসে; অদূরেই একটি আসনে বসে আছেন কাকু একটি শূন্য কাঁসার থালা নিয়ে; বাটিতে ডাল-তরকারি সাজানো; ছা হাঁড়ি থেকে এক ডাবুউফজ্বলন্তভাত তুলে কাকুর থালায় ঢেলে দিলেন গরম ভাতের ভাপ কাঁসার থালায় ছড়িয়ে পড়তেই কাঁসার রঙটা কেমন পালটে গেল! কাকু ডাল দিয়ে মেখে সেই ভাত মুখে দিলেন তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের দুধে-আলতা রঙ, আলতার ভাগই বেশি ভাত মুখে ঢুকতেই কাকুর মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল আর মাথা থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম নেমে কাকুর মুখটি হয়ে গেল গর্জন তেল মাখানো প্রতিমার মুখ ছা অপেক্ষা করছেন দ্বিতীয় দফা ভাত তাঁর থালায় তুলে দেওয়ার জন্যে

বাড়ির বাকিদের সেদ্ধ বা শক্ত ভাতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল কি না সেটা একমাত্র ছায়ের পক্ষেই জানা সম্ভব আমাদের ছোটোদের যে ছিল না সেটা আমি বলতে পারি ভাত নয়, বরং ডাল নিয়ে আমার মাথায় কখনও কখনও পোকা নড়ে উঠত আমাদের চাষে একমাত্র বিরি কলাইটাই হত বলে সারা বছর কালো কালো খোসাসহ যাঁতায় ভাঙা কলাইয়ের ডাল হত তবে কোনো কোনো বার সারা বছর চলার মতো কলাই হত না দু-এক মাসের জন্যে গোউর মাসান্তর ভুষিমালের দোকান থেকে মুগের ডাল আসত সেই ডাল দেখেই আমার মাথায় পোকা নড়ে উঠে খাব না বউদিরা বোঝানোর চেষ্টা করেন মুগ হল সব ডালের সেরা, কত দাম দিয়ে কিনতে হয় কিন্তু ভবি ভোলে না আমার বিরির ডালই চাই ছায়ের মুখে কথা নেই একটু পরেই কালো রঙের বিরির ডাল এনে আমার ভাতে ঢেলে দিলেন আমি সেই ডাল মেখে হৃষ্টচিত্তে চেটেপুটে ভাত খাই বউদিদের মুখে মুচকি হাসি আমার নজরে পড়ে না আমি জানতাম না আমার আড়ালে সেই হাসিই এমন অট্টরবে বেজেছিল যে ছা-ও হাসি চেপে রাখতে পারেননি মুগের ডালই লোহার কড়াইয়ে একটু জল দিয়ে ফুটিয়ে নিলেই যে সেটি ঘনকৃষ্ণ বিরির ডালে পরিণত হতে পারে এমন হেঁসেল-বুদ্ধি বার করতে ছায়ের সময় লাগেনি একটুও ইচ্ছার মর্যাদা পেয়ে ওজনদার মুখে সেই ছবছরের বালক নতুন বিরি না ওঠা পর্যন্ত কেবল তারই জন্যে করা সেই বিশেষ ডাল খেতে খেতে মনে মনে কাকু এবং বড়ো দুই দাদার সমকক্ষ হয়ে উঠছিল

সেই বয়সটায় আমাদের কাছে ছা যে বিশেষ প্রিয় ছিলেন তেমন নয়, বরং ভালোমন্দ খাবার ভাঁড়ারে রেখে তা থেকে একটু একটু বের করে দেওয়া আমাদের কাছে অত্যন্ত অন্যায় বলে মনে হত আমরা বালকবালিকারা প্রায়ই তাঁর কথার মুদ্রা নকল করে সমস্বরে ভেংচি কেটে তাঁকে উত্যক্ত করতাম কিন্তু ক্কচিৎ কখনও দু-এক দিনের জন্যে তিনি বাপের বাড়ি গেলে রান্নাঘরে ঢুকে মা-খুড়িমাকে ছায়ের জায়গায় দেখে অনুপস্থিত ছায়ের উপরই কেমন যেন রাগ হয়ে যেত একটু বড়ো হয়ে কোনো কোনো দিদি-বউদিদের মুখে ছায়ের কিছু নিন্দামন্দ শুনে হালকা একটা ছাপও কি পড়েনি মনে?

তাৎক্ষণিক বিচারে বহু ভুল থেকে যায়, চিন্তার স্বগম থেকে পরংগমে পৌঁছতে কালের ব্যবধান লাগে আজ এতখানি দূরত্ব হেঁটে পরিষ্কার বুঝতে পারি সেই অতি সাধারণ চেহারার দুর্ভাগ্যপীড়িত শীর্ণ মহিলাটির চরিত্রের মহিমা এক বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের ছোটোবড়ো সব সদস্যদের বায়নাক্কা সামলে যে তৃপ্তি তিনি পেতেন সেটুকুই ছিল তাঁর পরম পাথেয় প্রথম জীবনে রূপসী ও প্রখর ব্যক্তিত্বশালী শাশুড়ি এবং শেষ জীবনে প্রায় একই রকম রূপে-ব্যক্তিত্বে প্রখর পুত্রবধূর ছায়ায় কাটানো সেই ম্লান জীবন যেন সেকালের একান্নবর্তী পরিবারের প্রাণবিন্দু-স্বরূপ

.......................................

এক যে ছিল গ্রাম

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

.......................................

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত


মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।