এক যে ছিল গ্রাম। সেকালের পাউস

আমাদের গাঁকে ঘিরে কিছুটা অঞ্চল উর্বর এঁটেল মাটির হলেও তার থেকে দু-চার কিলোমিটার এগিয়ে বা পিছিয়ে গেলেই ল্যাটেরাইট মাটির রুখাশুখা বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেখানে শাল আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল সেইসব জঙ্গল-ঘেঁষা গাঁগুলোতে জলের খুব অভাব পুকুর-ডোবা যে নেই তা নয়, তবে গ্রীষ্মে তার বেশির ভাগই শুকিয়ে খটখটে দু-একটা পুরনো গভীর পুকুর অবশ্য আছে সেগুলোতে খানিক জল থাকে সেই জলে মাছও থাকে রুই-কাতলা, ট্যাংরা-পুঁটি বর্ষার নতুন জল লালমাটিতে মাখামাখি হয়ে সেই সব পুকুরে যখন তোড়ে নামতে থাকে মাছগুলো তখন পাগলা হয়ে যায় তিন-চার ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে তাদের মিলন-উৎসব উৎসব-শেষে থিক্থিকে জেলির মতো ডিম ভাসতে থাকে জলের উপরিভাগে তখন যে যার মতো জাল, ন্যাকড়া ইত্যাদি নিয়ে পুকুরে নেমে পড়ে সেই ডিম ছেঁকে তুলতে উৎসাহের আনাড়িপনায় বেশির ভাগ ডিমই নষ্ট হয় ছোট ছোট গর্ত খুঁড়ে সেই সব চাবায় ঢেলে রাখা ডিম থেকে সামান্য যা পোনা জন্মায়, স্থানীয় পুকুর-মালিকরাই তা দু-পাঁচ টাকায় কিনে নেয় এই করতে করতেই কোনো এক বছরে কোনো এক পুকুর-মালিকের মনে হল, এই বাৎসরিক ব্যাপারটাকে বারোয়ারি হাতে ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না বরং নিজে কিছু করতে পারলে দু-পয়সা হাতে আসতে পারে ভরা পুকুর থেকে ডিম তোলার অনেক সমস্যা সে মাথা খাটিয়ে প্রথম বর্ষণের আগে জঙ্গল-ঘেঁষা হিড়-এ বাছা বাছা কিছু পরিণত রুই-কাতলা পুকুর থেকে তুলে সেখানে ছেড়ে রাখল লালমাটির শালজঙ্গলের ধারে ধারে ঢালু হয়ে নেমে আসা কিছু অগভীর ডোবা থাকে বর্ষাকালে সেগুলো জলে ভরে যায় সেগুলোকেই লোকে হিড় বলে তো তার সেই প্রথম উদ্যোগ নিশ্চয়ই খানিকটা সফল হয়েছিল ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই সেই অ্যামেচারিস উদ্যোগ প্রফেশনাল হয়ে উঠল আর সেই প্রফেশনাল উদ্যোগেমাছের ডাক্তার’-এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল আকাশে মেঘ দেখে হিড়ে মাছ তুললেই যে বৃষ্টি হবে তার কোনও কথা নেই আবার বৃষ্টি হলেই যে মাছেরা উৎসবে মাতবে তেমন কোনো গ্যারান্টি নেই

এমন সময়ে বিষ্ণুপুর থেকে আগমন ঘটল মিজানুরের মিজানুর একহারা চেহারার ছটফটে ছোকরা, তার কালো মুখে দৃশ্যমান বড় বড় দাঁতগুলির সঙ্গে খুবই মানানসই তার চটপটে কথাবার্তা নিমেষেই সে ম্যাজিক দেখিয়ে দিল কয়েকটা মাছকে ইনজেকশন দিয়ে ছেড়ে দিল হিড়ে তারপর তার কথামতো পাশের খাল থেকে টুলু পাম্পে করে জল তুলে ফেলা হতে লাগল হিড়ের পাড়ে খুঁড়ে রাখা আলগা লাল মাটির ওপর সেই জল ঘোলা হয়ে হিড়ে নেমে আসার পরে পরেই শুরু হয়ে গেল মাছদের ছোটাছুটি হিড়ের সমস্ত মাছই একযোগে সামিল হয়ে গেল মদন-উৎসবে দেখতে দেখতে হিড়ের জল থিকথিক করতে লাগল নিষিক্ত ডিমে ডিম ফুটে পোনা ও সেই পোনাদের শুশ্রূষা ও সংগ্রহ করার পরবর্তী কাজে ততদিনে দক্ষ হয়ে উঠেছিল স্থানীয় মানুষরা ফলে হাতে হাতে লাভের সঙ্গে মিজানুরেরও ডাক্তারি খেতাব লাভ হয়ে গেল আমার এক জ্ঞাতি দাদা লেজুড়ের মতো মিজানুরের সঙ্গে সেঁটে গেল ওই এক মরশুম মিজানুরের সাকরেদি করেই পুরোপুরি ডাক্তার হয়ে গেল সে তার নাম শীলভদ্র, সংক্ষেপিত হয়ে ভদ্দ স্কুল ফাইনালে বসার আগেই স্বাধীনভাবে নিজের প্র্যাকটিস আরম্ভ করতেই লোকের মুখে মুখে ভদ্দ হয়ে গেল ভদর ডাক্তার

গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম দিকে কেমন ছিল হাতুড়ে কারিগরির মৎস-প্রজনন, ভদর ডাক্তারের একটি বড়সড় সফল অপারেশনের গল্প শোনালেই আপনারা তার স্বাদ পাবেন

সাইকেলের হ্যান্ডেলে ডাক্তারি ব্যাগ, যতটা জোরে সম্ভব প্যাডেল করছিল ভদর তাকে ভোর সওয়া পাঁচটার বাসটা ধরতেই হবে বৃষ্টি টিপ টিপ করে পড়েই চলেছে শেষ রাতে জোরে নেমেছিল কাল ছিল জ্যৈষ্ঠের শেষ দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভদর বোঝার চেষ্টা করছিল, বর্ষার মেঘই এসে পড়ল কিনা বীজতলা ডাগর হয়েছে কালবৈশাখীর বৃষ্টিতেই বীজ ফেলে দিয়েছিল চাষিরা মাঠে হাল দেওয়াও সারা বর্ষা যদি সত্যিই এত তাড়াতাড়ি এসে যায়, ধান রোয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে তারা ভদরেরকলআসায় ভাটা পড়ে যাবে তখন এই মরশুমে এখন পর্যন্ত চার-পাঁচটার বেশি কল পায়নি সে সেগুলো সবই বিশ-পঞ্চাশটা মাছের গতকালই প্রথম বড় কলটা পেল এত বড় কাজ এর আগে সে করেনি কখনো তিনশমাছের পাউস হবে তার মানে কম করে পনের মিলিগ্রাম গ্ল্যান্ড লাগবে সেটা স্থানীয়ভাবে মিলবে না তাই গঞ্জে চলেছে ভদর সেখানে মাছের পাইকিরি বাজারে সহজেই কুড়ি-পঁচিশটা বড়ো মাছের মাথা মিলে যাবে

সাড়ে ছটাতেই গঞ্জে পৌঁছে গেল ভদর আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্রয়োজনীয় মাছের মাথার ব্যবস্থা হয়ে গেল এক কারবারির চালায় বসে কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে না চালাতেই ভদরের অ্যাসিসট্যান্ট হুনকু এসে উপস্থিত হল ভদর আর দেরি না করে তার দিকে নিজের ফোলিয়ো ব্যাগটি এগিয়ে দিল হুনকু ব্যাগের ভেতর থেকে প্রথমেই বের করল হোমিওপ্যাথি ওষুধের দুটি ছোট শিশি সেগুলির অর্ধেক ভরা আছে মেথিলেটেড স্পিরিটে একটু তফাতে শিশি দুটি সাবধানে রেখে একে একে বের করতে লাগল ছোট্ট ট্যানসেল ব্লেড, স্ক্রু ড্রাইভার আর নরুন ভদর মাছের একটা মাথা হাতে তুলে নিতেই ট্যানসেল ব্লেডটা তার হাতে ধরিয়ে দিল হুনকু ভদরের নিপুণ হাতে ছোট করাতটি খুলির ঠিক মাঝখানে সওয়া ইঞ্চি বাহুর মাপের একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি করে ফেলল তারপর তিনটি বাহুতে স্ক্রু ড্রাইভারের পিছন দিয়ে আলতো করে টোকা দিতেই সেগুলি খুলে গেল ভদর বাক্সের ঢাকার মতো সেটিকে নরুনের আগা দিয়ে তোলার পরেও তার চার নম্বর বাহু খুলির সঙ্গে জুড়ে রইল ভদর এবার নরুন দিয়ে মাথার ঘিলু চেঁছে বের করে ফেলে দিল অমনি বেরিয়ে পড়ল গোলাপি রঙের মুসুরদানার আকারের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড নরুনের বাঁকানো মাথাটি দিয়ে গ্ল্যান্ডটি তুলে নিজের বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখের ওপর টিপের মতো বসিয়ে দিল ভদর পরবর্তী মাছের গ্ল্যান্ডটি না বের করা পর্যন্ত প্রথমটি তার নখের ওপরেই শুকোতে থাকে দ্বিতীয়টি বের করেই সে তার বুড়ো আঙুল হুনকুর দিকে বাড়িয়ে দেয় হুনকু তার নখের ওপর থেকে গ্ল্যান্ডটি নিয়েই স্পিরিটভর্তি শিশির মধ্যে ভরে ফেলে এভাবেই চলতে থাকে ভদর ডাক্তারের সার্জারি পর্ব গ্ল্যান্ড বের করার জন্যে এতো সূক্ষ্ম অপারেশনের উদ্দেশ্য হল, খুলির ঢাকা মাথায় চেপে বসিয়ে দিয়ে কারবারি দিব্যি সেগুলো অন্য খদ্দেরদের বিক্রি করতে পারবে তারা বুঝতেই পারবে না তার ভেতর থেকে ঘিলু আর গ্ল্যান্ড বের করে নেওয়া হয়েছে

বাস থেকে নেমে সাইকেলে ওঠার আগে ভদর দেখল, ঘড়ির কাঁটা বারো ছুঁই ছুঁই আকাশ থেকে মেঘেরা উধাও রোদের তাপ ঝলসে দিচ্ছে গায়ের চামড়া মনটা একটু দমে গেল তার বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই, আকাশ মেঘলা থাকলেও পাউসের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এই খটখটে আবহাওয়ায় মাছদের তাতানো কঠিন লোকেরা তো সব খতিয়ে দেখবে না, বদনাম হবে ভদরের দু-এক দিন যে পিছিয়ে দেবে তারও উপায় নেই আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল মাছ তোলা হয়েছে হিড়ে পুষ্টিকর চাল খাইয়ে তাদের ট্যানকো করা হয়েছে ডিম ছেঁকে তুলে রাখার জন্যে শখানেক চাবা খোঁড়া হয়েছে কিন্তু রোদের এই তাপ থাকলে সেখানে ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে ডিম ফুটে পোনা বের হওয়ার আগেই অনেক নষ্ট হয়ে যাবে এদিকে এখনও মেলা কাজ বাকি গ্ল্যান্ডগুলোকে স্পিরিট থেকে তুলে ব্লটিং পেপার দিয়ে শুকনো করতে হবে তারপর চিনামাটির খলনুড়িতে সেগুলোকে মেড়ে ডিস্টিল্ড ওয়াটারের সঙ্গে মিশিয়ে একটা টেস্ট টিউবে ভরতে হবে ঢালাই অ্যালুমিনিয়ামের মিক্সারে সেই টেস্টটিউব রেখে মিক্সারটা চালাতে হবে প্রবল ঘূর্ণনে ডিস্টিল্ড ওয়াটারের সঙ্গে গুঁড়ো-করা গ্ল্যান্ড মিশে গেলে দেখা যাবে গ্ল্যান্ডের সঙ্গে লেগে থাকা ঘিলু, রক্তজালিকা টেস্টটিউবের তলায় থিতিয়ে পড়েছে তখন টেস্টটিউবের উপরিতল থেকে ধীরে ধীরে ইনজেকশনের সিরিঞ্জে ভরে নিতে হবে সেই মিশ্রণ

তৈরি হয়ে বিকেল চারটায় হিড়ের পাড়ে পৌঁছে ভদর দেখল আকাশে ঘন হয়েছে মেঘ, পুকুর-মালিকের লোকেরা একটু দূরে তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করছে হিড়ের পাড়ে মেলা লোকের ভিড়, মাছ পাউস অতি চিত্তাকর্ষক ও দর্শনীয় ঘটনা এদিকে তার অপারেশন টেবিলও প্রস্তুত চওড়া বেঞ্চের ওপর চটের মোটা গদি, তার ওপর শ্যাওলা-মাখা নরম ঘাস হিড়ের জলে তিনশো মাছের মধ্যে একশো আশিটি পুরুষ একটা স্ত্রী মাছের পেছনে গড়ে দেড়টা করে পুরুষ শুক্রের অভাবে একটা ডিমও যাতে ঘোলা হয়ে না যায় পেশেন্টদের একে একে জল থেকে তুলে আলতো করে চেপে উপুড় করে শোয়ানো হবে গদির ওপর ডাক্তারবাবু রুগির ওজন আন্দাজে পরিমাণমতো ওষুধ সিরিঞ্জ দিয়ে ঢুকিয়ে দেবেন তলপেটের পেশীতে ইনজেকশন দেওয়া সাঙ্গ হলেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে আলতো করে হিড়ের জলে বাছা বাছা তিরিশটি মাছকে ইনজেকশন দিতে হবে তাদের মধ্যে স্ত্রী মাছের সংখ্যা একটু বেশি হওয়া দরকার গরম হওয়া স্ত্রী মাছের সংখ্যা বেশি হলে পুরুষগুলো সব তেতে উঠতে সময় নেয় না ফোলিও ব্যাগ খুলে সিরিঞ্জ ও টেস্ট টিউব বের করে কাজে লেগে গেল ভদর

পাম্পের সাহায্যে নদীর জল পাইপ বেয়ে এসে আছড়ে পড়ছিল লাল মাটিগোলা গর্তের মধ্যে সেখান থেকে নিয়ন্ত্রিত ধারায় সেই ঘোলা জল নেমে আসছিল পাউসের হিড়ে ভদর নিমগ্ন হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল মাছেদের গতিবিধি জেনারেটারের তীব্র আওয়াজে মাছেদের চলাচলের শব্দ ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল ভদর জেনারেটার বন্ধ করে দিতে বলল আর জল ঢোকানোর দরকার নেই জেনারেটার বন্ধ হতেই স্পষ্ট বোঝা গেল, ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে মাছেদের আর ঠিক তখনই বৃষ্টি নামল তোড়ে মুহূর্তেই তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল হিড়ের মধ্যে জল তোলপাড় করে গায়ে গা ঘষতে ঘষতে নেচে বেড়াতে লাগল উন্মত্ত মাছের দল কেউ বাদ নেই অংশ নিতে ভদর বুঝে গেল চরম মুহূর্ত এসে গেছে স্ত্রী-মাছেরা ডিম ছাড়তে প্রস্তুত আর তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে সেঁটে আছে জোড়া-পুরুষ, নিমেষেই ডিমের ওপর শুক্রধারা বর্ষণ করার জন্যে চার-সেল টর্চের আলো মাঝে মাঝে আছড়ে পড়ছে নৃত্যরত মাছেদের ওপর ভদর আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠল কাল থেকেই দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়বে তার এই কীর্তির খবর সে কল্পনার চোখে দেখতে পেল বাঁকের দুই প্রান্তে দুই বিশাল আলুমিনিয়ামের হাঁড়ি ঝুলিয়ে দলে দলে ছুটে আসছে পোনার খদ্দের

.......................................

এক যে ছিল গ্রাম

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

.......................................

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত


মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।