এক যে ছিল গ্রাম। চিতু ও তার হাজামতখানা।
চিতু নাপিত রোগা, ছোটোখাটো চেহারার মানুষ। মাথার সামনের দিকে ডিম্বাকৃতি একটি টাক। পরনের ছ’হাতি ধুতি হাঁটুর উপরেই থাকে, গায়ে হাফহাতা গেঞ্জি, শীতকালে একটি খদ্দরের চাদর গলায় জড়ানো থাকে। খালি পায়ে ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটত চিতু – সবাই বলত, কুল-আঁটি আছে চিতুর পায়ে। সে-আমলে অনেকরই পায়ে কুল-আঁটি থাকত, গোড়ালির তলায় চামড়াসহ মাংসের একটা শক্ত ডেলা। চিতুই অনেকের কুল-আঁটি অপারেশন করত, নিজেরটা কেন করেনি কে জানে!
তো চিতু নাপিত ক্রিয়া-কর্ম বাদ দিলে মাসে দু’দিন আসত আমাদের গাঁয়ে তার যন্ত্রপাতির থলেটি নিয়ে। থলের মধ্যে ক্ষুর-কাঁচি-নরুন-চিরুনি ছাড়াও থাকত একটি কাঠের উঁচু পিঁড়ি, একটি তুবড়ানো এনামেলের বাটি, এক খণ্ড শুকনো চামড়া এবং একটি মসৃণ পাথর। পিঁড়িটি তার যজমানের বসার আসন আর শেষোক্ত বস্তু দুটি তার ছুরি-কাঁচিতে শান দেওয়ার অস্ত্র। চিতু এসেই গাঁয়ের মাঝখানে একটি ঝাঁকড়া আম গাছের তলায় তার সরঞ্জাম পেতে বসে পড়ত। আসার পথেই তার আগমন-বার্তা ঘোষণা হয়ে যেত। ফলে সে বসতে না বসতেই তার ছোটোবড়ো যজমানরা একে একে এসে হাজির হত সেখানে। চিতুর কাছে মাথা নোয়ানোয় তীব্র আপত্তি ছিল অধিকাংশ কুচেকাঁচার, তার আগমন-বার্তা ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টায় থাকত। ফলে তাদের সঙ্গে তাদের বাবা-দাদাদের বেশ এক প্রস্থ দাড়িয়াবন্ধ খেলা জমে যেত। গাঁ-ময় সেদিন কেবলই শোনা যেত চিতু-নাম।
— ও পঞ্চা, চিতু এসছে রে – যা-যা খেউরিটা সেরে লিগে যা —।
—ও খুড়ো, তুমার মাঝো ছেল্যাটার চুলটা যে বেদম বড় হয়ে গেছে, যাও যাও চিতুর কাছে লিয়ে যেয়ে কাটিয়ে লাও সকাল সকাল —।
—হ্যাঁরে পতু, তোর ছোটো মেয়াটার চুলে এমন উকুন হয়েছে যে তাদের ডানা গজিয়ে গেছে! যা-যা চট করে চিতুর কাছে যেয়ে ন্যাড়া করে দে —।
আমার কাকুর ছিল বই পড়ার
নেশা। গাঁয়ে পড়ার মতো বই জোগাড় করা খুবই
দুরূহ ব্যাপার।
তাই বেশির ভাগ সময়েই
তাঁকে পুরনো পঞ্জিকা পড়ে কাটাতে হত। সেটাও
অবশ্য তিনি উপন্যাস-পাঠের মতোই অভিনিবেশ সহকারে পড়তেন। চিতুর আগমন-বার্তা তাঁর কানে ঢুকত না। তাই চিতু এলেই বাবার কাজ ছিল ‘রামনিধি কোথায় – রামনিধি কোথায়’ – বলতে বলতে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ানো। কারণ, মাঠ-ঘাট, গাছতলা-কুয়োতলা, মায় গোয়াল পর্যন্ত ছিল কাকুর রিডিং-লাইব্রেরি। দেখতে পেলেই তাঁর হাত ধরে টানতেন বাবা – উঠো রামনিধি উঠো,
চিতু কখন এসেছে – হাজামত সেরে নাও আগে,
তারপরে এসে না হয় পড়বে আবার!
মনে রাখতে হবে, বাবা তখন ষাটোর্ধ্ব,
কাকু পঞ্চাশোর্ধ্ব। বেশির ভাগ লোক ‘খেউরি’ বললেও বাবা ‘হাজামত’-ই বলতেন।
ছোটোদের কেবল চুল-নখ কাটা বা ন্যাড়া হওয়া,
বড়োদের চুল-নখ-গোঁফ-দাড়ি এবং বগল-চাঁছা – এই হল হাজামত। মেয়েদের চুল কাটার প্রশ্ন নেই, তাদের দাড়ি-গোঁফ গজায় না, কেবলই নখ কাটা। চিতুর বুড়ি মা সেটা মাঝে মাঝে এসে সম্পন্ন
করে দিয়ে যেত।
বছরের শেষে গাঁয়ের প্রত্যেকের
বাড়ি থেকে পাওনা ধানের বস্তা আদায় করে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে বাড়ি ফিরত চিতু। আমাদের গাঁ ছাড়াও আরও তিনটি গ্রাম ছিল তার
যজমান। এই চার গ্রামের পাওনা থেকেই চলত তার
সংসার। তার থেকেই দু-এক বিঘে জমিও বোধ হয় কিনেছিল
সে।
চিতুর ধবধবে ফরসা ছেলে – কালো তার নাম, সে-ও বহুদিন বহন করেছিল চিতুর উত্তরাধিকার। শেষের দিকে রাস্তার ধারে এক খণ্ড জায়গা কিনে
সেলুন খুলেছিল সে।
তারপর তো গ্রামগুলোই
উধাও হয়ে গেল।
কেবল তাদের নামগুলোই
থেকে গেল। এখন চিতুর নাতিরা সেখানে পাশাপাশি
দুটি বিউটি পার্লার খুলেছে, একটি জেন্টস পার্লার, অন্যটি লেডিস পার্লার। লেডিস পার্লারে বেশি ভিড়, পরির মতো সাজুগুজু মেয়েরা
সেখানে কাজ করে।
আমি তো সেই চিতুর সঙ্গেই থেকে গেছি আট বছরের বালকটি হয়ে - হাঁ করে ভাবতে থাকি, এরই মধ্যে নখ ছাড়াও আরো কী কী সব গজিয়ে গেল মেয়েদের যে হাজামতখানায় তাদের এত ভিড়!
.......................................
এক যে ছিল গ্রাম
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
.......................................
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment