এক যে ছিল গ্রাম। আমাদের ঠাকুরবাড়ি

 ঘুম থেকে উঠেই টের পেলাম আজ বিশেষ দিন আজ আমাদের ঠাকুরসেবার বারি বাবার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছেও রামনিধি, চাষিদের খবর দেওয়া হয়েছে? আনাজের বস্তা ঠাকুরবাড়ি কে নিয়ে যাবে?

-চাষি আমাদের চাষি নয়, ঠাকুরের চাষি ঠাকুরের অনেক জমি সেই জমি চাষ করে যারা খায় তারা ঠাকুরের চাষি ঠাকুরবাড়ির এক একটা কাজের ভার তাদের উপরে কেউ বারিওয়ালার বাড়ি থেকে আনাজের বস্তা মাথায় নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে পৌঁছে দেবে; কেউ ভোগ রান্নার কুচো (জ্বালানিকাঠ) কেটে সেখানে রেখে আসবে; কেউ ভোগের প্রসাদ খাওয়ার জন্য শালের কুচি (সরু কাঠি) দিয়ে কাঁচা শালপাতা সেলাই করে থালা বাটি বানিয়ে রেখে আসবে; আবার কেউ বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে গিয়ে সেখানে পাত পেড়ে প্রসাদ খাওয়ার পর সকলের উচ্ছিষ্ট পাতা তুলে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির উঠোন পরিষ্কার করে দিয়ে আসবে শিলাবতী নদীর পাড়ে ঠাকুরবাড়ি বর্ষাকালের পর মাস দেড়-দুই নদী নাব্য থাকে নদী পারাপারের নৌকা বাওয়ার ভারও দেওয়া আছে কোনো কোনো চাষিকে তাদের প্রত্যেকের প্রতিদিনের ভোগ খাওয়ার অধিকার সবাই সেখানে পাত পেড়ে খায় না, কেউ কেউ বালতি ভরে ভোগ নিয়ে বাড়ি আসে

উঠোনে দুটো আনাজের বস্তা সাজিয়ে রাখা আছে একটা বস্তায় পাঁচ-খানা পাকা ডিঙলা (কুমড়ো), অন্যটায় কয়েক সের করে আলু-বেগুন, আর কখনও বা তার সঙ্গে এক কাঁদি কাঁচকলা বস্তা দুটো একবার দেখে নিয়ে বাবা চলে গেলেন রান্নাঘরেও বৌমণি (আমার জেঠিমা, আমরাছাবলি), ঠাকুরের মুড়কি হল? ছানা ছিটানো হয়েছে?

রান্নাঘরে বউদিরা সকালবেলাতেই চান সেরে মুড়কি তৈরি করতে লেগে গেছেন ছা নিজেই বিরাট এক কড়াইয়ে দুধ চাপিয়েছেন উনোনে দুধ ফুটলেই লেবু দিয়ে ছানা কাটাবেন খুড়িমা গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজছেন লুচি হয়ে গেলে ছানাশীতল ভেজে ফুটন্ত, চিটচিটে আখের গুড় তার উপরে ঢেলে এমনভাবে মাখামাখি করবেন যে ঠান্ডা হলে শীতলের উপর গুড়ের একটা শক্ত খোলস পড়ে যাবে -সবই ঠাকুরের জলখাবারের ভোগ, যাবে ঠাকুরবাড়িতে ছা বললেন, – হচ্ছে হচ্ছে, সবই হচ্ছে সময়েই হয়ে যাবে

বাবা ব্যস্ত পায়ে অন্য দিকে চলে যান ছা মুচকি হেসে বউদের দিকে তাকিয়ে বলেন, – মধ্যম কত্তার সবেতেই তরস্তরি!

বাবা আবার চলে গেছেন কাকুর কাছেএবারে সিনানটা সেরে নাও রামনিধি বেলা হয়ে গেল ভোগের চাল, পায়েসের চাল সাজিয়ে রেখেছেন বৌমণি

এই দুরকমের আলোচাল কাকুর কাঁধে চেপে ঠাকুরবাড়ি যাবে জলখাবারের মুড়কি, লুচি-ছানাশীতল, ফল, ছানা নিয়ে যাবে বাড়ির বউ-মেয়েরা দিনের প্রথম প্রহর শেষ হতে না হতেই এইসব ঠাকুরবাড়িতে পৌঁছনো চাই দু-আড়াই মাইল রাস্তাকিছুটা এঁটেল মাটির, কিছুটা আল বেয়ে, নদী পেরিয়ে গেলে তবে পাথরবেড়্যার ঠাকুরবাড়ি খালি পায়ে হাঁটা ঠাকুরবাড়িতে খালি পায়ে যাওয়াই নিয়ম না হলেই বা কিজুতো পরার চলই নেই বাড়ির বড়োদের জুতো আছে বটে, কিন্তু সেগুলো এক কোণে পড়েই থাকে বাবা আর কাকুর ক্যাম্বিসের জুতো আমার ছায়ের ছেলে যে-বড়দা, আমরা বলি ঠাকুন্নানাতার একজোড়া খড়ম আছে পড়েই থাকে প্রায় কাঠের খড়মের আগার দিকে চওড়া ফিতে লাগানো লুকিয়ে সেই খড়ম পায়ে দিয়ে চলতে গিয়ে একদিন মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম প্রায় সকলেই ঠাকুরবাড়ি হেঁটে যায়, তবে আজকাল কেউ কেউ সাইকেলে চেপেও যায় সাইকেলের পথ অনেক দূর, ঘুরে ঘুরে যেতে হয়

গোসাঁইদের ঠাকুরবাড়ি তিনশো পঁয়ষট্টি দিন দু-বেলা ঠাকুরের ভোগের ব্যবস্থা যত লোকই আসুক পাত পেড়ে পেট ভরে ভোগ খেয়ে যাবে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বারিওয়ালার আদি পুরুষ বাগবীজ গোস্বামীর নাতিপুতিরা বাড়তে বাড়তে এখন দুটো গ্রাম হয়ে গেছে তিনশোর উপর শরিক বারি সকলের সমান নয় আমরা বড়ো তরফ বলে আমাদের বারি সবচেয়ে বেশি বছরে ছদিন তার মধ্যে পাঁচটাই পার্বণের দিন মকর, দোলপূর্ণিমা, রামনবমী, মহাষ্টমী আর অন্নকোট তাই আমাদের বারি মানেই ঠাকুরবাড়ি জমজমাট অনেক লোক তাই বাবা চিন্তায় থাকেন তিনি সব বারির দিন যান না কাউকে না কাউকে বাড়িতে থাকতেই হয় বাবার সুগার, তাই তিনিই বেশির ভাগ দিন বাড়িতে থাকেন সন্ধের মুখে সবাই ঠাকুরবাড়ি থেকে ফিরলে তিনি কাকুকে বলেন, – সব ভালোভাবে মিটেছে তো রামনিধি, সবাই স্বচ্ছভাবে প্রসাদ পেয়েছে তো?

কাকুর মুখের বাক্যিটি শুরু হওয়ার পর শেষ হতে একটু সময় লাগে তার আগেই আমাদের জানা আছে কাকু বলবেন, – রামচন্দ্রের কৃপায় আমাদের বারিতে কি কোনোদিনই কি কিছু কম পড়েছে মধ্যম নানা (দাদা)!

এবার একটি দিনের ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার স্মৃতি শুনিয়ে দিয়ে এই পর্বে দাঁড়ি টানব ঠাকুরবাড়ি ও তার আজীবন সঙ্গি বকুল গাছটির বিশদ বৃত্তান্তের সঙ্গে আমার পরিণত বয়সের অনুভব তুলে রাখছি পরের পর্বের জন্যে

ভর গ্রীষ্মের এক ঠাকুরসেবার বারির দিনে এক দাদা বাদে সবাই চলে গেছে সেখানে বাবাও যাবেন, তবে একটু বেলা করে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরে আমিও বসে আছি বৈশাখের আগুনে দুপুরে বাইরের হাওয়া রোদ্দুরে কেঁপে কেঁপে উঠছে বাবা পুকুরে চান সেরে ভিজে গামছাটা বিড়ে পাকিয়ে মাথায় দিয়েছেন তাঁর গামছা গরমকালে রোদ্দুরে শুকোয় না এইভাবেই বিড়ে পাকানো অবস্থায় কলসির মাথায় সরার উপরে রাখা থাকে শুকিয়ে উঠলে আবার তাকে জলে ভেজাতে হয় এই অভ্যাস কেবল বাবারই, কোত্থেকে শিখেছেন কে জানে!

বাবার হাত ধরে বেরোলাম দুজনেরই খালি গা, বাবার পরনে খদ্দরের খাটো ধুতি, আমার ইজের বাবার মাথায় ভিজে গামছার টুপি রাস্তা কমানোর জন্যে বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়েই মাঠে নেমে গেছেন বর্ষা থেকে হেমন্ত পর্যন্ত মাঠে ধান থাকে, তখন আলের পথে ঘুরে ঘুরে যেতে হয় এখন ন্যাড়া মাঠে আলের খোঁজে কাজ কিযেদিকে যাবে সেদিকেই পথ ঠাকুরবাড়িকে নিশানা করে সোজা হাঁটা দিয়েছেন বাবা, পাশে আমি এঁটেল মাটির চষা মাঠ রোদ্দুরে ফুটিফাটা কাঁটার মতো পায়ে বিঁধছে গরম হাওয়ায় সারা শরীর শুকিয়ে কাঠ তেষ্টায় বুকের ছাতি শুকিয়ে মুখের ভেতর পর্যন্ত জ্বালা করছে আমি আর পারছি না আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা কিছু বুঝলেন তাঁর মাথার গামছা তখন শুকিয়ে খড়খড়ে, সেটাই খুলে আমার মাথা-গলায় জড়িয়ে দিলেন সারা মাঠে কোনো বড়ো গাছও নেই, নদী তখনও খানিক দূরে মাঠের আলে কয়েকটা বাবলা গাছ কেবল দাঁড়িয়ে তারই পাতলা ছায়ায় খানিক বসলেন বাবা আমাকে নিয়ে সেই সামান্য ছায়াই যেন জুড়িয়ে দিল গা মনে পড়ে গেল ঠাকুরবাড়ির বকুল গাছের ছায়ায় সুশীতল চাতালটির অনুভব তারই টানে বাকি পথটুকু অনায়াসে পেরিয়ে যাওয়া যায়

.......................................

এক যে ছিল গ্রাম

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

.......................................

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত


মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।