এক যে ছিল গ্রাম। বুড়ো সাইকেল
সাত আট বছর বয়েস পর্যন্ত প্রকৃতির কোলে থাকা নদী, খাল-বিল, গাছপালা থেকে শুরু করে মানুষের কাছে থাকা কুকুর বিড়াল গরু মোষ, মায় সাপ ইঁদুর পিঁপড়েদের দিকেই মনটা পড়ে থাকত। মানুষের বানানো কোনো কিছুর দিকে চোখ টানল পাঠশালার শেষের দিকে। সেই যন্ত্রটির নাম সাইকেল। তাকে কায়দা করতে পারলে মাটির উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যায়। তখনও ঘরে ঘরে আসেনি সাইকেল তবে প্রায় সব গাঁয়েই দুএকটা করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কেউ সাইকেলে চেপে রাস্তা দিয়ে গেলে অনেকেই চোখে ঈর্ষা মাখিয়ে তাকে দেখতে থাকে – ভাবটা এমনই - একবার যদি পথচলতি কাউকে ধাক্কা মেরেছিস সাইকেল দিয়ে তখন তোর সাইকেলে চাপার মজা বের করব!
আমাদের
পাঠশালার বড়ো পনশয়ের একটা বিচ্ছিরি দেখতে সাইকেল ছিল। রঙচটা, সিট-ছেঁড়া সেই সাইকেলটায়
চেপে পাঁচ মাইল দূরের নিজের গ্রাম থেকে সোমবারের সকালে আমাদের গ্রামে আসতেন। ছোট খোকনদের বাড়ি সারা সপ্তা থেকে শনিবার
বিকেলে নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিতেন। নির্জন মাঠে একটা পুকুরের পাশে একা পড়ে থাকা আমাদের পাঠশালাটা গ্রাম
থেকে মাইল দেড়েক দূরে। সেই পথটাও তিনি সাইকেলে করে যেতেন। সেই সাইকেলের ছিরি দেখে তাকে সাইকেলে চাপার
মজা দেখাবার চেষ্টা বোধহয় কেউ কোনোদিন করেনি।
আমাদের
গাঁয়ে অন্য কোনো বাড়িতে না থাকলেও আমাদের বাড়িতেই ছিল তিন তিনখানা সাইকেল। এক নম্বর সাইকেলটা আমার বাবার। তার নাম বুড়ো সাইকেল। অনেক পুরনো হলেও তার হ্যান্ডেলটা খুব চকচকে, তার মাঝখানে খোদাই করা
– হারকিউলিস মেড ইন ইংল্যান্ড। দু নম্বর সাইকেল বাড়ির বড়ো ছেলে চন্দ্রশেখরের। অ্যাটলাস, মেড ইন ইন্ডিয়া। তিন নম্বর সাইকেলটা আমার একমাত্র জেঠতুতো
দাদা হরিশঙ্কর, মানে পচাইবাবুর। র্যালে, মেড ইন ইংল্যান্ড। কোনোটাই কেনা নয়, সবই পাওয়া। বুড়ো সাইকেল বাবা পেয়েছিলেন তাঁর মামা, ভেলাইডিহার রাজা প্রাণবল্লভের
কাছ থেকে। তিনি তাঁর
এই ভাগনেটিকে খুবই ভালবাসতেন। তাঁকে নিয়ে তাঁর অনেক রকম পরিকল্পনা ছিল যার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি
কিছু আকস্মিক দুর্ঘটনার কারণে। কিন্তু সেসবের সঙ্গে বুড়ো সাইকেল কেন, কোনো সাইকেলেরই কোনো সংশ্রব
নেই।
অতএব
সাইকেলে ফিরি। সেই সময়টায়
গ্রামাঞ্চলে অবস্থাপন্ন বাড়ির পাত্রে মেয়েকে রাখতে হলে যে-বরপণ লাগত, তার মধ্যে সাইকেল ঢুকে পড়েছিল। সেই সূত্রেই চন্দ্রশেখর এবং হরিশঙ্করের
সাইকেললাভ। দেখতে দেখতে
আমাদের বাড়িতে সাইকেলের সংখ্যা তিন থেকে চার হয়ে গেল। হিমাংশুশেখরের বিয়ে হলো। শ্যামলা রঙের বউদির সঙ্গে এল একটু নীলচে
রঙের চকচকে এক সাইকেল। নাম সেনর্যালে, মেড ইন ইন্ডিয়া। তার ফুল চেনগার্ড, চেনের মধ্যে ধুতির খুঁট
কিংবা ফুলপ্যান্টের ডগা আটকে যাওয়ার উপায় নেই। সব মিলিয়ে বেশ জবরদস্ত দেখতে। তাতে অবশ্য আমার কোনো লাভ হলো না। সাইকেলের দিকে আগের মতোই জুলজুল করে তাকিয়ে
থাকাই সার। বুড়ো সাইকেল
আর চন্দ্রশেখরের সাইকেল দিনমানে দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, বাবা আর চন্দ্রশেখর যে-যার সাইকেলে চেপে দুনিয়াময় টহল দিয়ে বেড়ান, বেলা না ডুবলে
ঘরে ফেরেন না। বাবা তো রাতের অন্ধকারেও কোনো কোনোদিন সাইকেল চালিয়ে ফেরেন। গাঁয়ের লোক বলে, মধ্যম কত্তা ঘুমাতে ঘুমাতেই
সাইকেল চালান। বাবা অবশ্য সেকথা মানেন না। মা বলেন,
তাহলে সেদিন সাইকেল থাক্যে পড়ে পায়ের চামড়া আর কাপড় ছিঁড়ে লিয়ে ঘরকে
আল্যেন কীকরে? বাবা বলেন, পথে গচকা ছিল
দেখতে পাইনি।
বাবার
কৈফিয়ত বেকার গেল। ঘরে বাইরে
সবাই নিশ্চিত হলো মধ্যম কত্তা সাইকেল চালাতে চালাতে ঘুমান।
তিন নম্বর
সাইকেল বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকলেও তার মালিক পচাইবাবুর তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে তাতে হাত
দেওয়ারও উপায় নেই। নতুন সেনর্যালেও সেই গোত্রে পড়ল। হিমাংশুশেখর প্রতি সকালে ঘুম থেকে উঠেই
তাকে ঝেড়েপুঁছে, তেল খাইয়ে চকচকে করে তালা মেরে দেন। দেখেশুনে আমারও চোখে বোধহয় সাইকেলমালিকদের
প্রতি ঈর্ষা জাগল আর তা থেকেই একদিন একটা কেলেংকারি কাণ্ড ঘটে গেল। সে এমনই কাণ্ড যে চেনাজানা মানুষদের মধ্যে
আমার নাম ছড়িয়ে পড়ল। আরও আশ্চর্যের কথা যে ভয়ংকর সেই কাণ্ডের গল্প বলতে বলতে সবাই একচোট বেশ হেসেও
নিতে থাকল।
পুব দিক
থেকে আমাদের গাঁয়ে ঢুকতে রাস্তার ধারের প্রথম বাড়িটাই হাবু ঘোষের। একটা মাত্র মাটির ঘর, একফালি বারান্দা,
একটা গোয়ালচালা আর দুটো পেয়ারা গাছ নিয়ে সেই বাড়ি। দুজন মাত্র লোক, হাবু আর তার ছেলে জগা। হাবু দিনের বেলায় হেথাহোথা ঘুরে বেড়ায় আর
জগা গোটা কয়েক কুকুর আর একটা গাই নিয়ে সে-বাড়িতে রাজত্বি করে। সে-সময়টায় আমি সবে পাঠশালা যেতে শুরু করেছি আর সেই সময়টুকু
ছাড়া বাকি সময়ে জগা-ই হয়ে উঠেছে আমার অভিভাবক। বিবিধ শিক্ষায় সে আমাকে দীক্ষিত করে চলেছে। একদিন সে আমাকে একটা কাঁড়বাঁশ(ধনুক)তৈরি করে দিল। হাত দেড়েক লম্বা, সরু বাঁশের বাতার দুই প্রান্ত একটা শক্ত বাবুই দড়ি
দিয়ে টান করে বেঁধে তৈরি হল সেই কাঁড়বাঁশ। সেই সঙ্গে তিন চারটে প্যাকাটি(শুকনো পাট গাছের লাঠি)র মাথায় কাদার ডেলা গুঁজে দিয়ে কাঁড়(তির)ও প্রস্তুত করে দিয়ে জগা বলল, --যার উপরেই রাগ হবেক তুমার
স্যাত করে কাঁড় চালাই দিব্যে।
এমন একখান
অস্ত্রের মালিক হয়ে কখন কার উপরে রাগ হবে তার জন্যে অপেক্ষা করার তর সইল না আমার। অস্ত্র হাতে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরেই দেখি সাইকেল চালিয়ে একজন অচেনা
মানুষ আসছে। আমি ধনুকে
প্যাকাটির কাঁড় জুতে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাছে এলেই ‘মারব মারব?’ বলে ভয় দেখাব কিন্তু কাঁড়
ছাড়ব না। লোকটা আমার
ভয় দেখানোকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখি আর একটা সাইকেল এগিয়ে
আসছে। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম, আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে তিন-চার মাইল গেলে তার গ্রাম, জুনশোল। সে ছোট ইস্কুলের মাস্টার আর তার শ্বশুরবাড়ি
আমাদের গাঁয়েই। এবারেও আমি
মারব মারব বলে ভয় দেখাতে গেলাম কিন্তু ধনুকের বাবুই দড়ির ছিলা থেকে আমার হাত ফস্কে
কাঁড় বেরিয়ে গিয়ে সোজা তার বুকে গিয়ে লাগল। সব্বোনাশ! দেখি গাঁয়ের জামাই সাইকেল
থেকে নামল, কাঁড়টা রাস্তা থেকে তুলল, তারপর
সাইকেলে স্ট্যান্ড দিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি এক ছুটে জগার ঘরে ঢুকে দরজার কপাটের
পিছনে লুকালাম। একটু পরেই
জামাই দরজার ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কিন্তু বাইরের রোদ থেকে
এসে ঘরের অন্ধকারে আমার দিকে তাকিয়েও আমাকে দেখতে পেল না। সে ফিরে যাওয়ার একটু পরে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে
সাবধানে রাস্তায় এসে এদিক ওদিক উঁকি মারলাম। হাবু ঘোষের ঘর পেরিয়ে দুগ্গামেলা, তারপরে আমাদের পুকুর, পুকুর পেরিয়েই আমাদের বাখুল। দেখি জামাই রাস্তার ধারে সাইকেল রেখে আমাদের
বাখুলে ঢুকল। আমি খুব ভয়
পেলাম এবার, নিঘ্ঘাত বাবার কাছে নালিশ করতে ঢুকেছে জামাই।
হেমন্তের
বেলা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। জগা পেয়ারা গাছের তলায় তার কুকুরগুলোকে অ্যালকাচ্ছে। আমি দুরুদুরু বুকে তার কাছে গিয়ে সব বললাম। জগা যদি কোনো বুদ্ধি করে আমাকে বাঁচায়! কিন্তু সে বুদ্ধি বের করার
আগেই কাকু পিছন দিক দিয়ে এসে আমার বগলের তলায় হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরে আমাকে হিড়হিড়
করে টানতে টানতে নিয়ে চললেন বাড়ির দিকে। বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তার ধারেই, বাখুলের পশ্চিম দিকের গোয়ালের
পাশে। তাঁর কাছে
নিয়ে এসে কাকু আমার হাত ছেড়ে দিলেন। বাবার মুখে রাগ থমথম করছে। তিনি বললেন, --কী – তুমি জুনশোলের জামাইবাবুকে কাঁড় মেরেছ!
বলেই
হাত তুললেন তিনি। সেই হাত শেষ
পর্যন্ত আমার গায়ে পড়ত কি-না জানি না। কারণ তার আগে তিনি কোনোদিনই আমার গায়ে হাত তোলেননি। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মাথা গুলিয়ে গেল, আমি দৌড় লাগালাম রাস্তার
দিকে। আর ‘ধর ধর’ বলতে বলতে বাবাও ছুটলেন আমার পিছু পিছু।
বাবার
বয়স ষাটের কাছাকাছি, আমার বছর আটেক। আমি সারাটা গ্রাম ঘুরে মাঠের আলে পা রেখেছি, বাবা পিছু ছাড়েননি। স্বভাবতই এই মনোরম ‘দৌড় প্রতিযোগিতা’
দেখতে রাস্তায় ভিড় জমে গেছে। বিশেষত, বাবা এলাকার এক মান্য এবং বিবেচক মানুষ;
এবং তিনি কি-না ছেলেকে দুষ্কর্মের শাস্তি দিতে
তার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন!
আমি যখন
আঁকাবাঁকা আলপথে মাঠের মধ্যিখানে, ততোক্ষণে বাবার দম বোধহয় শেষ, নিভে এসেছে
ক্রোধও। ওদিকে দ্রুত
নেমে আসছে অন্ধকার। বাবা দাঁড়িয়ে
পড়ে হাঁক দিলেন, --আবার যদি ছুটেছো, পা ভেঙ্গে দেব একেবারে!
সঙ্গে
সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি। বাবা বললেন, --এদিকে এসো।
আমি ধীর
পায়ে ফিরে এলাম বাবার কাছে। তিনি বললেন, --কান ধরো। বলো ‘এমন কাজ আর কোনোদিন করবো না’। তৎক্ষণাৎ বাবার আদেশ পালন এবং গায়ে অন্ধকার
মেখে হা-ক্লান্ত
বাবার পিছন পিছন গুটি গুটি পায়ে বাড়ি ফেরা।
.......................................
এক যে ছিল গ্রাম
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
.......................................
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment