বীরেশ্বর সামন্ত হত্যারহস্য।। শাক্যজিৎ।। শারদ নির্মুখোশ ১৪৩০।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

শারদ নির্মুখোশ ১৪৩০ এ প্রকাশিত শাক্য জিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ' বীরেশ্বর সামন্ত হত্যা রহস্য ' পড়ে লিখেছেন পায়েল দত্ত। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
...........................................

বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য আদতে কোনো রহস্য নয়, পাপ ও তার পরিণামের বহুবিধ সমীকরণের আড়ালে এ এক আদ্যন্ত রাজনৈতিক উপাখ্যান। এ কাহিনীতে কোনো রহস্য নেই, আছে যা তাকে বলা যায় বংশানুক্রমে ক্ষমতায়ন ও শোষণের নাগপাশে আবদ্ধ শোষিত মানুষের জীবনের গল্প, তাদের অসহায়তা, লাঞ্ছনা, ক্ষমতাশালীর দুরন্ত চালে নির্মম মৃত্যু এবং প্রতিশোধপরায়ণতা। এ কাহিনী আসলে সামন্ত ও বাগালদের পুরুষানুক্রমিক সম্পর্কের খতিয়ান।

কাহিনীর শুরু থেকেই খুনীর পরিচয় জ্ঞাত। খুনী নিজেই ঘোষণা দিয়ে জ্ঞাত করিয়েছে তা দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন ঘেঁষা জনপদের – যা কয়েক পুরুষ ধরে সামন্তদের অধিকার ও শাসনাধীন – মানুষগুলোকে, এমনকি প্রায় দিন ক্ষণ সহ সমস্তটাই। এমত পরিস্থিতিতে হত্যাটুকু অবশ্যম্ভাবী ছিল, স্বঘোষিত হত্যাকারীর স্পর্ধাটুকুই আসলে গুরুত্বপূর্ণ এখানে।

নদীর মোহনার ধার ঘেঁষা এক ছোট্ট জনপদ, দূর থেকে গগনচুম্বী ইঁটভাটার চিমনি সদর্পে ঘোষণা করে সে জনপদে সামন্তদের একচ্ছত্র আধিপত্যের বার্তা। সামন্তদের পূর্বপুরুষ মাটি খেত, মাটির আভ্যন্তরীণ পুষ্টি দিয়ে তাদের প্রাণ নির্মিত, তাই এই মাটির ভাগ নিয়েই শুরু হয়েছিল লড়াই। এই লড়াইয়ের উৎস বহু আগে, যখন সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়েছে দেশ, বামফ্রন্ট তখনও ‘ব্যান পার্টি’, জোতদার সামন্তদের নানাবিধ অত্যাচারে ভূমিহীন হচ্ছে রায়ত কৃষকের দল, ভাগচাষী হয়ে যাচ্ছে ভাতুয়া, বর্গাদার হয়ে যাচ্ছে খেতমজুর। বীজ বপন হচ্ছে তেভাগা আন্দোলনের। আর জন্ম নিচ্ছে সামন্তদের সঙ্গে বাগালদের বংশানুক্রমিক শত্রুতা, নাকি বন্ধন ? অচ্ছেদ্য তা। 

এই সম্পর্কের সমীকরণ কাহিনী জুড়ে বার বার বদলে বদলে গেছে। কখনও ঘৃণা কখনও বা সমর্পণ। নিত্য শুধু শোষণটুকু, সে শোষণের রূপও যদিও বদলেছে বারবার, তার মধ্যেও স্থির তবু সপ্তমী বা রোহিণীর মত নারীদের ভবিতব্য। 

উপন্যাসে এক বিস্তীর্ণ সময়কালকে ধরেছেন লেখক, স্বভাবে যা অস্থির। উপন্যাস দেখেছে স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস শাসন, বামফ্রন্ট সরকারের জন্ম ও পতন ও বর্তমান তৃণমূল সরকারের শাসনামল। এক দু'বার বামফ্রন্টের নাম নেওয়া ছাড়া কোথাও সরাসরি উচ্চারিত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলোর নাম, রুলিং পার্টি - বিরোধী পার্টি বলেই চিহ্নিত হয়েছে তারা, তবু তাদের চিনে নেওয়ার অসংখ্য ক্লু ছড়ানো আছে উপন্যাসে, বীরেশ্বর সামন্তর হত্যাকারীর মতোই যা সমুজ্জ্বল পরিস্ফুট। আর এই গোটা সময়কাল জুড়ে অত্যাচার ও শোষণের চরিত্র যেভাবে বিভিন্ন প্রকার বাঁক নিয়েছে তাই এ উপন্যাসের উপজীব্য। হত্যা ও হত্যাকারীর পুলিশের হাতে খুবই নিরীহ ও নির্বিরোধী ভাবে ধরা পড়ার পরেও যা পড়ে থাকে তা এক ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত – আরও বড় খুনির, আরও বড় হত্যার, আরও বীভৎস অত্যাচারের। যে রহস্য আর রহস্য নেই তার সমান্তরালে বয়ে যায় অন্য এক ইঙ্গিত – এই ইঙ্গিতটুকু ধরতে পারাই এই রহস্য উপন্যাসের আসল রহস্য, যা বুঝতে পেরে শিড়দাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে যায়; আদতে এই ভয়ঙ্করতম সময়টাতেই তো বাস করছি আমরা।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য এই উপন্যাসে আবারও ম্যাজিক দেখিয়েছেন হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে। রত্নেশ্বর-যোগেশ্বর-বীরেশ্বর-সর্বেশ্বর সামন্ত ও ভীষ্ম-ভীম-দেবু বাগাল, সপ্তমী, নকুল কাঁটাল, রোহিণী, পল্টু প্রত্যেকটি চরিত্রের নিজস্ব চিন্তা ভাবনার গতিপথ যে চরম মুন্সীয়ানায় ও আশ্চর্য ব্যতিক্রমী গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি তাতে আবারও তাঁকে টুপি খুলে কুর্ণিশ করতেই হয়।

▪️বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য / শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
▪️শারদ নির্মুখোশ‌‌‌ (সুপ্রকাশ কর্তৃক প্রকাশিত)

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।