স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন।। জয়া মিত্র।।

উঁচুজাতের মেয়েরাও দেবদাসী হয়। যারই চুলে জটা থাকে তাদেরই ইয়েলাম্মার মন্দিরে এসে দেবদাসী হতে হয়। ওই জটাই ইয়েলাম্মার ইচ্ছাপত্ৰ। জটা না থাকলেও দেবদাসী হয় মেয়েরা, যাদের মা কিংবা বাপ-মা মেয়েকে মানত করে ইয়েলাম্মার মন্দিরে সেবাদাসী বলে। কতো কারণে মানত করে, পরপর বাচ্চা মরে গেলে মানত করে, এরপর যে জন্মাবে তাকে তোমার সেবায় দেব। যাদের কোন ছেলে নেই তারা ছেলে পাবার জন্য একটা মেয়েকে দিয়ে দেবার মানত করে, কেউ বা অন্য মেয়েদের বিয়ে-থা হয়ে গেলে কে দেখবে বলে সবচেয়ে বড় মেয়েটিকে দেবদাসী করবে বলে মানত করে দেয়। যেমন ললিতার মা-বাপ করেছিল। কোন ছেলে ছিল না, কেবল তারা পাঁচবোন বলে ললিতার বাবা-মা তাকে মানত করেছিল ইয়েলাম্মার কাছে। আট বছর বয়সে শেষট্টি মন্দিরের মেলায় দীক্ষা হয়েছিল তার। মা বাবার কাছেই ছিল। ভাই জন্মাল অরো দু বছর পর। তাই আর বাবা-মাকে মেয়েকে ঘরে রাখতে হল না। যখন ছেলে জন্মাল, 'ফুল ভাঙা'র জন্য মানে কুমারী মেয়ের সঙ্গে প্রথম রাত কাটানোর জন্য টাকা-পয়সা, গয়না দিতে রাজি গৌড়েও পাওয়া গেল, তখন পুরোহিত আর পাটিলের কথামত রাজি হয়ে গেল তারা। এই প্রথম রাতের যে মালিক, সেই দেবদাসীর ‘স্বামী'। ব্রাহ্মণ জাতের হতে হবে তাকে। পরে যদি সে অন্য মেয়েও নেয়, নিয়েই থাকে, তাহলেও দেবদাসী জানবে সেই তার স্বামী। সেই মুত্তু কাটুয়ে শেষে ললিতাকে তার স্বামী রেখে গেল এই নাগহল্লি মন্দিরে।

উঁচুজাতের মেয়েরা যখন দেবদাসী হয়, যখন তাদের চুলে পাওয়া যায় জটা কিংবা তাদের পরিবার মানত করে ইয়েলাম্মার কাছে, তাদের বেলা এসব নিয়ম হয় না। ইয়েলাম্মার হাত থেকে সাদা পুঁতির মালা পায় যে মেয়েরা তাদের কেবল মেলায় আসতে হয়, রাণ্ডি ছন্নিমেতে মন্দিরে আসে শোকের গান গাইতে, মুত্তাইদে হুন্নিমেতে নতুন কাপড় পরে, পায়েস রাঁধে দেবীর জন্য। মেলায় আনন্দ করে। মেলায় উৎসবে নৈবেদ্য, দেবীর শাড়ি-গয়না উপহারের জন্য টাকা দেয় তারা। সেই মেয়েরা, সাদা পুঁতির মালা গলায় পরা সেই দেবদাসীরা বিয়ে করে। ঘরসংসার করে নিজেদের স্বামী ছেলে- মেয়ে নিয়ে। তাদের মান খুব। কিন্তু সেই সাদা পুঁতি তো কনকাম্মা, বিরজা কি ললিতাম্মার মত দলিত মেয়েরা কখনও পায় না। তাদের ইয়েলাম্মা দেন কেবল লাল-সাদা মেলানো পুঁতি, আর না হলে লাল পুঁতি। লাল-সাদা মেলানো যাদের মালা, তারা জোগতী হয়ে যায়। তারা এক জায়গায় বসত করবে না। ঘুরে ঘুরে কীর্তন গেয়ে ইয়েলাম্মার মহিমা প্রচার করে বেড়াবে গ্রামে গ্রামে। দিনে তিনটে পাঁচটা কি সাতটা ঘরে ভিক্ষা করবে। যা পাবে ফুটিয়ে খাবে আর ইয়েলাম্মার মহিমা গাইবে। বয়েস বাড়লে বাসবীরাও কেউ কেউ জোগতী হয়। গাঁয়ে গাঁয়ে এরাই খুঁজে বার করে কোন মেয়ের চুলে ইয়েলাম্মার জট আছে। ইচ্ছে হলে জোগতী কারো সঙ্গে থাকতেও পারে না-ও পারে। সুন্দরী কমবয়সিরা আর জোগতী হয় কই। জোগতী হয় অসুস্থ কি খুঁতো কিংবা বয়েস হয়ে যাওয়া মেয়ে পুরুষ। জোগতী আর জোগাপ্পা। 

কিন্তু লালপুঁতির মালা যে পাবে তার সেই স্বাধীনতা নেই। তাকে হতেই হবে বাসবী। ইয়েলাম্মার যে কোন ভক্ত তাকে সম্ভোগের অধিকারী। এবার একজন এজমান তাকে পাকাপাকি রেখে তার দায়িত্ব নেবে না যে যখন আসবে তারই সেবা করতে হবে, সে বাসবীর ভাগ্য। কোন নিচু জাতের মেয়ে লাল-সাদা পুঁতির মালা যদি বা কখনো পায়, শুধু সাদা পুঁতি পেয়েছে, এমন কেউ কখনও শোনেনি। যেমন শোনা যায়নি কখনও যে উঁচুজাতের কোন দেবদাসীকে লালমালা দিয়েছেন ইয়েলাম্মা। মন্দিরের পুরোহিত বলে নিচু জাতের মেয়েদের বেশি ভালোবাসেন ইয়েলাম্মা তাই সবসময়ে তাদের রাখেন কাছাকাছি। কে জানে হবেও বা। কনকাম্মা এতো ভাবতে পারে না। কনকাম্মা শুধু ভাবে কী করলে তার নিজের পেটের মেয়ে ইয়েলাম্মার রাগ না ডেকে আনে। একটু সহজ বুদ্ধিতে নিয়ম মেনে যেন চলে। যে দয়া তাকে ইয়েলাম্মা করেছেন, তা যেন থাকে তার মেয়েরও ওপর। এই যে তাকে অন্যদের মত মাথায় বিন্দিগে আর হাতে ডোল নিয়ে জল ভরতে যেতে হয় না মাইল মাইল হেঁটে এমনকি চম্পকী বাভিতেও সে যায় না এখন আর, তার গৌড়ে অন্যকে দিয়ে সে কাজ করিয়ে দেন, রক্তবাসিনী দেবীর অশেষ দয়া ছাড়া কি তা হত!

.
.
স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন
জয়া মিত্র
.
প্রচ্ছদ : কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা
.
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।