হাফ প্যাডেলের কাল।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।

গড়বেতায় বিদ্যুতের লাইন আছে কিন্তু উকিলবাবুর মেসে নেই। খরচ বাড়িয়ে আরামে অভ্যস্ত হওয়ার কী দরকার – বিজলি বাতির কথা উঠলেই উকিলবাবু এটা বলেন। মেসে যারা থাকে তাদের যেসব গাঁয়ে বাড়ি, সেসব গাঁয়ের ধারেকাছেও বিদ্যুৎ নেই। লন্ঠন হ্যারিকেনের আলোয় তারা দিব্যি দেখতে পায়, পড়াশোনাও করতে পারে। বালকের একটি বেঁটে হ্যারিকেন আছে। সন্ধের আগে ন্যাকড়া দিয়ে তার কাচ পরিষ্কার করে, কেরোসিন তেল ভরে রাখতে হয়। সেদিন সবাই শুয়ে পড়ার পর বারান্দায় শতরঞ্চি পেতে বেঁটে হ্যারিকেনের আলোয় পড়ার বইয়ের নীচে ‘চরিত্রহীন’ রেখে নিশ্চিন্তে পড়ে যাচ্ছে সে। বারান্দার অন্য প্রান্তে খাটিয়া পেতে ঘুমোচ্ছে আদিত্যদাদা। তার নাক ডাকার আওয়াজ যত বাড়ছে, বালক ততই বেশি করে ডুবে যাচ্ছে অন্য এক মেসবাড়ির সতীশ আর সাবিত্রীর গল্পে। কখন যে তার পড়ার বই চরিত্রহীনের উপর থেকে সরে গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ ‘দেখি তো কী বই পড়ছ এতো রাতে–’ শুনে চমকে ওঠে বালক।

আদিত্যদাদা বইটা কেড়ে নিয়ে বইয়ের নাম পড়ল। বলল, –এই বয়সেই চরিত্রহীন পড়ছ! দাঁড়াও, কাল সকালেই আমি উকিলবাবুকে বলছি।

বইটা নিয়ে নিজের বালিশের নীচে রেখে শুয়ে পড়ল আদিত্যদাদা।

উকিলবাবু লম্বা, টকটকে ফরসা, খাড়া নাক, চোখের কোটর গভীর, ঘন ভুরু। তিনি বালকের বাবার বন্ধু, কাকুর বেয়াই, মানে তাঁর ছোটো মেয়ে নির্মলার সঙ্গে উকিলবাবুর বড়ো ছেলে নীরদের বিয়ে হয়েছে। তারা সবাই দেশের বাড়িতে থাকে। এখানে উকিলবাবু আর তাঁর ছোটো ছেলে কমল। কমল বালকদের স্কুলেই পড়ে, ক্লাস টেন। দুর্গাশঙ্করের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হয়ে গেছে, রেজাল্ট বেরোলে কলেজে ভর্তি হবে। উকিলবাবুর উল্টো দিকের যে-ঘরে দুর্গা আর বালক থাকত, সেই ঘরে এখন উকিলবাবুর মেজ ছেলে হুদুদাদা থাকে। তার ভালো নাম শশধর। সে কলেজ পাশ করে কাছাকাছি একটা স্কুলে মাস্টারি পেয়েছে। বালক মেসবাড়ির দোতলার পশ্চিমপ্রান্তের ছোটো ঘরটায় একলাই থাকে। দুর্গা চলে যাওয়ায় সে কিছুটা স্বাধীন,  নিজের টাকা নিজেই খরচ করতে পারে। কিন্তু চটির মিষ্টির দোকানে গিয়ে গিয়ে চার আনা দামের মাতৃভোগ এখনও খাওয়া হয়নি তার। এখন উকিলবাবুই তার একমাত্র গার্জেন কিন্তু কলেজের দাদারাও তার উপর গার্জেনগিরি করে। কাল যদি সে গরমের জন্যে বারান্দায় শুয়ে চরিত্রহীন না পড়ে ঘরের মধ্যেই পড়ত তাহলে এই বিপদটা হতো না।

উকিলবাবু কোর্টে গিয়ে মামলা লড়েন, এটুকুই শুনেছে বালক। মামলা লড়া জিনিসটা কী - ভেবেও কোনো কুলকিনারা পায়নি। সে দেখেছে, সক্কালবেলাতেই অবিকল টিকটিকির মতো চেহারার কালীমুহুরি আসেন। উকিলবাবু ইংরাজিতে গড়গড় করে কীসব বলতে থাকেন আর তিনি সাদা ফুলস্কেপ কাগজে তা লিখতে থাকেন। লেখা হয়ে গেলে উকিলবাবু পরীক্ষার খাতা দেখার মতো কালীমুহুরুরির ভুল আবিষ্কার করে সেগুলো ঠিক করতে থাকেন আর তাঁকে ধমক দিতে থাকেন। তারপর সেই কাগজগুলো বগলদাবা করে মুহুরিবাবু সেগুলো টাইপ করাতে কোর্টে ছোটেন। বালকের আন্দাজ, সেই টাইপ করা কাগজগুলোই লড়াই করার হাতিয়ার। আর একটা ব্যাপার আছে উকিলবাবুর। সন্ধেবেলায় তাঁর বন্ধু বঙ্কিম উকিল তাঁর সঙ্গে গল্প করতে এলে তিনি খুবই উদাত্ত গলায় ইংরাজি কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। জ্বর হলে তো কথাই নেই, ফোয়ারার মতো ইংরাজি কবিতার স্রোত বইতে থাকে। জ্বর না ছাড়া পর্যন্ত রেহাই নেই। কমল বলেছে, সেগুলো বড়ো বড়ো ইংরেজ কবির লেখা কবিতা। বালক ইংরেজ কবিদের বিষয়ে প্রায় কিছুই জানে না। তাদের ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে শেলি আর ওয়ার্ডসওয়ার্থ নামে দুজন কবির কবিতা আছে। আর একজনের লেখা একটা গল্প সে বাংলায় পড়েছে। কিং লিয়ার। লেখকের নাম শেক্সপিয়ার। তবে তিনি কবি কি-না জানে না বালক। লাইব্রেরিতে বিদেশি লেখকের লেখা কিন্তু বাংলায় অনুবাদ করা অনেক গল্প-উপন্যাস আছে। সেগুলোও তার পড়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু এখন সেসব নির্ভর করছে চরিত্রহীন-অপরাধের কী শাস্তি হয় তার উপরে।

উকিলবাবুর কবিতা-প্রীতি সত্ত্বেও তাঁকে বেশ ভয়ই পায় বালক। কারণ, মেসে যারা থাকে তাদের জন্যে তিনি কয়েকটা নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। এক, রাত নটার মধ্যে সবাইকে মেসে ফিরতে হবে। দুই, সিনেমা দেখা চলবে না। কারণ সিনেমায় ‘ল্যাংটা নাচ’ হয়। তিন, গল্পের বই পড়া চলবে না। কারণ নভেল পড়লে ছাত্ররা উচ্ছন্নে যায়। শেষ দুটো ব্যাপার অদ্ভুত লাগে বালকের। সে দুর্গাপুরে থাকতে দুটো সিনেমা দেখেছিল। তাতে কোনো নাচই ছিল না। আর উকিলবাবু এতো ইংরাজি জানা সত্ত্বেও যেকোনো গল্পের বইকেই কেন যে নভেল বলেন!

‘চরিত্রহীন’ অবশ্য নভেলই। এখন উকিলবাবুর বিচারে তার ‘উচ্ছন্নে’ যাওয়ার কী পরিমাণ স্থির হয় কে জানে! সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই ভয়ে ভয়ে আছে বালক। যখন প্রায় নটা বাজে, স্নান করতে যাবে কিনা ভাবছে, তখনই কালীমুহুরি কাগজপত্তর নিয়ে বিদায় হলেন আর তার ডাক পড়ল উকিলবাবুর কাছে। বালক গিয়ে দেখে উকিলবাবু চেয়ারে বসে, তাঁর টেবিলে চরিত্রহীন বইটি। টেবিলের সামনে মুখ নিচু করে দাঁড়াল সে।
–এই বইটা পড়ছিলে?
বালক মাথা হেলিয়ে স্বীকার করে।
–কে দিয়েছে এটা?
–লাইব্রেরি থেকে এনেছিলাম।
–কোন লাইব্রেরি?
–পাবলিক লাইব্রেরি।
–কার্ড কোথায় পেলে?
বালক তোতলাতে তোতলাতে কার্ড পাওয়ার ইতিহাস বলে। উকিলবাবু নিদান দেন, সেদিন বিকেলে লাইব্রেরি খোলামাত্র সে যেন বইটা জমা দিয়ে আর কার্ডটা সুমিতের বাড়িতে ফেরত দিয়ে তবে মেসে ঢোকে।
–আর যদি কোনোদিন শুনি তুমি এইসব অশ্লীল নভেল পড়ছ, তাহলে মধ্যম কত্তা(বালকের বাবা)-কে বলে তোমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করব। সেখানে বাগালি আর গাড়োয়ানি করে খাবে।

উকিলবাবুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল বালক। চরিত্রহীন তখনকার মতো অসমাপ্ত রইল। সুমিত ভরসা দিয়েছে। কিছুদিন যাক। তারপর বালকের পছন্দমতো বই সুমিতই লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসবে। তার বাড়িতেই বই থাকবে। বালক ফাঁক বুঝে এসে পড়ে নেবে।

হাফ প্যাডেলের কাল
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
.......................................................
আসছে

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।