খন্ডপ্রহর।। অবিন সেন।। শারদ নির্মুখোশ ১৪৩০।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

শারদ নির্মুখোশ-এ প্রকাশিত অবিন সেনের উপন্যাস ‘খণ্ডপ্রহর’ পড়ে লিখেছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। উপন্যাসের সঙ্গের এই ছবিটি এঁকেছেন সৌজন্য চক্রবর্তী।
...............................................................

সপ্তদশ থেকে বিশ শতকের প্রথম অর্ধ পর্যন্ত ভারতের সামাজিক ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক রূপান্তরের পর্ব। এর অন্তত এক শতাব্দী আগে থেকেই ফিরিঙ্গি বণিকরা এই ভূখণ্ডে পা রাখলেও ভারতীয় সমাজকে প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়েছিল সতেরো শতক থেকে। এই ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে নিহিত চিত্তাকর্ষক উপাদানগুলি যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের আকর, সেটা বোধ হয় বাঙালি লেখকরা তেমনভাবে উপলব্ধি করেননি। নইলে এই পর্বকে আধারিত করে লেখা বাংলা উপন্যাসের সংখ্যা এত কম হওয়ার কথা নয়। অবিন সেনের এই উপন্যাস সেখানে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হতে পারত বা পুনর্লিখনে এখনও সে সম্ভাবনা প্রবল। আমার এই পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দেব উপন্যাসটি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর। 
অবিনের লেখা আগে পড়িনি। এই উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি থেকেই তাঁর গদ্য আমাকে প্রবলভাবে টানতে শুরু করল। যেন হালকা তুলির টানে বিন্ধ্যবাসিনী চরিত্রের প্রাথমিক স্কেচটি এঁকে ফেললেন লেখক। কাহিনির কাঠামোয় দুটি বিন্দু। একটি অতীতের অন্যটি বর্তমানের। প্রথম বিন্দু স্পষ্ট, উজ্জ্বল। দ্বিতীয় বিন্দু ঝাপসা। বর্তমানকে রহস্যাবৃত রাখার জন্য এটা লেখকের ইচ্ছাকৃত প্রয়াস। কাহিনি যতই এগোয়, এই অস্পষ্টতা মিলিয়ে যেতে থাকে কিন্তু প্রথম বিন্দু যার কেন্দ্রে আছেন রতিকান্ত বসু, সেটা যেমন উজ্জ্বল হতে থাকে, দ্বিতীয় বিন্দু, যার কেন্দ্রে সাত্যকি, ততোই অনুজ্জ্বল এবং তাৎপর্যহীন বোধ হতে থাকে। অথচ সাত্যকিকে প্রথমেই অতি চমৎকারিত্বে উপস্থাপন করেছিলেন লেখক। সে মহাভারতের সত্যকনন্দন, ভূরিশ্রবাকে বধ করাই যার জীবনের পরম লক্ষ্য। শেষে একবিংশ শতাব্দের দোরগোড়ায় এসে পিতৃপুরুষের সম্পদে বলীয়ান হয়ে রতিকান্তর আত্মাকে আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে কোনসব অন্যায়ের প্রতিকারে ব্রতী হবে সে ঠিক বোঝা গেল না। সে অন্যায় কি কেবল দশাননরূপী প্রমোটার-কৃত? ভূরিশ্রবার এতখানি অধঃপতন! 
কাহিনির কাঠামোকে সরল করে দেখে নেওয়া যাক। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে কাহিনি শুরু হয়ে সম্ভবত বিশ শতকের শেষে বা একুশ শতকের গোড়ায় শেষ হচ্ছে। শেষের সময়কাল স্পষ্ট করে বলেননি লেখক। কিন্তু ঘটনার বিবরণ থেকে সেই ইঙ্গিত উঠে আসে। পাঁচ প্রজন্মের কাহিনি। পঁচিশ বা তিরিশ বছরে এক প্রজন্ম ধরলেও হিসেবটা সেরকমই হয়। প্রজন্মের দ্বিতীয় পুরুষ রতিকান্ত বসুর জীবনই এই উপন্যাসের চুম্বক অংশ। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যতাসহ এই অংশের নির্মাণ করেছেন অবিন। কলকাতায় এই প্রজন্মের প্রথম পুরুষ, টোল-শিক্ষক বামাকান্ত ছিলেন হুগলির এক প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র কথক ঠাকুর। জীবিকার সন্ধানে পাঁচ বছরের বালকপুত্র, রতিকান্ত সহ কলকাতায় এসে চাকরি পান জমিদার রামতারণ দত্তের বাড়িতে, সেই বাড়ির শিশুদের গৃহশিক্ষক হিসাবে। বালক বয়স থেকেই বাবার কাছে শোনা মনসামঙ্গলের চাঁদ সওদাগর হয়ে ওঠে রতিকান্তর আরাধ্য দেবতা, তার ভবিষ্যজীবনের আদর্শ। বাণিজ্য জাহাজ সমুদ্রে ভাসিয়ে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে ব্যাবসা করে বিত্তবান হওয়া তার জীবনের লক্ষ্য। প্রথমে জমিদারের বিল সরকার তারিণী ঘোষাল ও পরে এক ইংরেজ বণিক, জেমস লিভিংস্টোনের সহায়তায় মুন্সির কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন রতিকান্ত। পরবর্তীকালে ওই সাহেবের বদান্যতায় এবং বন্ধু, এক আমেরিকান সাহেব জোসেফের সঙ্গে অংশীদারি ব্যাবসায় সফল হয়ে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন রতিকান্ত। 
উনিশ শতকের গোড়ায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাঁইবোনা গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে চূড়ামণি দত্ত সাহেবদের মুৎসুদ্দি হয়ে ক্রমশ নানা পথে প্রভূত অর্থ অর্জন করে শেষ পর্যন্ত জমিদার হয়ে বসেন। এইভাবেই এই দেশে এক ধরনের মুৎসুদ্দি-ধনতন্ত্রের সূচনা হয়। উনিশ শতকীয় রেনেসাঁ নিয়ে যত আলোচনা, আখ্যান ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে আছে, এই ধনতন্ত্রের জন্মকথা নিয়ে তেমন কিছুই নেই। অথচ চূড়ামণি দত্ত ইত্যাদিদের নিয়ে চিত্তাকর্ষক আখ্যান তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যা ভারতীয় ধনতন্ত্রের স্বরূপটিকে জানার পথে অনেকখানি সহায়ক হতে পারত। এই চূড়ামণি এবং তার পুত্র কালীপ্রসাদের মিলিত জীবনের ছায়ায় রতিকান্ত বসুর জীবন বোধহয় নির্মাণ করেছেন অবিন। কালীপ্রসাদ তাঁর বেলেঘাটার বাগানবাড়িতে ‘আনরো’ বিবি নামে পরমাসুন্দরী এক মুসলমান উপপত্নী রেখেছিলেন। সেই নিয়ে তখনকার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে প্রবল হাঙ্গামা হয়। কালীপ্রসাদকে হিন্দু সমাজ পরিত্যাগ করে। পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য সুবর্ণমুদ্রার সহায়তায় জাতে ওঠেন। একই ঘটনা ঘটেছে এই উপন্যাসে রতিকান্তর জীবনে। এ ছাড়াও উনিশ শতকীয় চারিত্র্য-সাযুজ্যে বিদ্যাসাগরের সহায়তায় বাল্যসখী বিধবা সুধাময়ীকে রতিকান্তর বিবাহ, তার আগে এবং পরে সুধাময়ীর বাবা, তারিণী ঘোষালের আচরণ, লিভিংস্টোনের মুন্সি হিসাবে রতিকান্তর গঙ্গায় নিমগ্ন জাহাজ নিলামে ক্রয় করে তৎক্ষণাৎ পর্তুগিজ সাহেবকে অভাবনীয় উচ্চ মূল্যে বিক্রয় – সবই অসাধারণ মুনশিয়ানায় বাস্তবসম্মত করে তুলেছেন লেখক। আমার মনে হয়েছে আরও বিস্তৃত পরিসরে কেবলমাত্র রতিকান্ত বা তিনি ও তাঁর পুত্র কৃষ্ণকান্তর জীবন নিয়ে পুরো উপন্যাসটি যদি শেষ করতেন অবিন, তাহলে তা একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখিত হতে পারত। কিন্ত তিনি, সম্ভবত আঙ্গিকের মোহে পড়ে, কাহিনিকে টেনে পঞ্চম প্রজন্মে নিয়ে এসে উপন্যাসের শেষে গুপ্তধন এবং এক গূঢ় তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ছোঁয়া দিয়ে রতিকান্তর আত্মাকে সাত্যকির ভেতরে প্রতিষ্ঠিত করলেন। পূর্বপুরুষের অর্থ এবং রক্তের কল্যাণে তার সুপারহিরো হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেল! 
প্রধানত বিদেশি সাহিত্যের প্রভাবে প্রাচীন ও অর্বাচীনকে যাদুবাস্তব বা কালবাস্তব প্রক্রিয়ার এক বিন্দুতে মিলিয়ে দেওয়ার চল এখন দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যে। অবিনও সম্ভবত তাই করতে চেয়েছেন। ফলে পরিসরের অভাবে উনিশ শতকীয় পর্বে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেল, বিশ শতকে একই সঙ্গে অসম্পূর্ণতা এবং অসঙ্গতি থেকে গেল। সংক্ষেপে উল্লেখ করি সেগুলোঃ 
১। মার্থা গোমেজের অসুস্থতার পরিণতি এবং তাঁর সম্পত্তি রতিকান্তর অধিকারে আসা নিয়ে পাঠকের কৌতূহল জাগ্রত করেই সে বিষয়ে নীরব হয়েছে উপন্যাস। 
২। এতখানি আকুলতা নিয়ে এবং বিপত্তি পেরিয়ে সুধাময়ীকে বিয়ে করার পর কোন পরিস্থিতিতে এবং কোন মোহে পড়ে রুকশানা বেগমকে উপপত্নী হিসাবে গ্রহণ করলেন রতিকান্ত, তা অতি সংক্ষিপ্ত এবং রুকশানার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়ন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকায় উপন্যাসের রসহানি ঘটেছে। 
৩। সুধাময়ীর গর্ভজাত কৃষ্ণকান্ত এবং রুকশানার গর্ভজাত গৌরকান্তর মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে মামলার কোনো বিবরণ নেই। 
৪। কৃষ্ণকান্তর চরিত্র অন্ধকারেই থেকে গেছে। তাঁর পুত্র কিরাতকান্ত নাকি কৃষ্ণকান্তর উপপত্নীর গর্ভজাত সন্তান – এই তথ্য একটিমাত্র বাক্যে ছুড়ে দিয়েই নীরব থেকেছে উপন্যাস, এর সত্যাসত্যের নিস্পত্তি না করায় উপন্যাসের অঙ্গহানি ঘটেছে। 
৫। কিরাতকান্তকে একবারই দেখা গেল যখন তার বয়স মাত্র আট। সে দেখছে কীভাবে তার দাদু রতিকান্ত পণ্ডিত-সংসর্গে পাওয়া গূঢ় পদ্ধতিতে স্বর্গারোহণের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এরপর তাঁকে দেখা গেল যখন সুন্দরী, বিদুষী, ও চরম বামপন্থী মানসিকতার বিন্ধ্যবাসিনী তাঁর প্রেমে আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে মন্দিরে মালাবদল করে ও সিঁদুর পরে তাঁর স্ত্রী হয়ে গেলেন। কিরাতকান্ত যে কংগ্রেসি রাজনীতির একজন পাণ্ডা হয়েছেন, সেটুকুই জানা গেল কিন্তু তাঁর সেই রমণীমোহন ব্যক্তিত্বের স্বরূপ বা সেটি গড়ে ওঠার পথরেখা উপন্যাসে অনুপস্থিত। বিয়ের পর কিরাতকান্তের বাড়ি এসে তাঁর আগের পক্ষের স্ত্রীর কথা জেনে স্বামীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও সেই বাড়িতে থেকে গেলেন বিন্ধ্যবাসিনী কেবল উনিশ শতকীয় সতী চরিত্রের, কিন্তু অন্তরে বিদ্রোহী সতীন কমলার টানে। কেবল তাই নয়, পরবর্তীকালে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী পরিবারের মাধবীকেও প্রেমের জালে জড়িয়ে কিরাতকান্ত বিয়ে করলেন যখন তৃতীয়বারের জন্যে, তখন বিন্ধ্যবাসিনী তার গর্ভস্থ সন্তানের হাতে রতিকান্তর গুপ্ত সম্পদ তুলে দিয়ে তাকে সুপারহিরো করে তোলার লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করলেন। একজন প্রগতিশীল বিদুষী নারীর এই রূপান্তরের কোনো বিশ্বাসযোগ্য আবহ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে উপন্যাসটি।
অবিন সেন বিষয়ে বিন্দুমাত্র পূর্বজ্ঞান আমার নেই। এই উপন্যাস পড়ে আমার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে তিনি এক সম্ভাবনাময় লেখক। বিশেষত আমার এই লেখার প্রথমেই উল্লেখিত সময়কে ধরে ঐতিহাসিক তথা সামাজিক উপন্যাস রচনায় যদি তিনি মনোযোগ দেন, বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যেতে পারবেন।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।