হাফ প্যাডেলের কাল।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।

এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে জীবন্ত বালিহাঁস ঝুলিয়ে বাড়ির পথ ধরেন অহিভূষণ। সাঁতার বাহিনী হাঁসের কথা ভুলে বালির চড়ায় হাডুডু খেলার জন্য তৈরি হয়। দুটো দল, বিভিন্ন মাপের ছ’জন করে খেলুড়ে এক একটা দলে। মাথার উপর চড়া রোদ, পায়ের নীচে গরম বালি। তা হোক, দু-পা দূরেই তো দহের ঠান্ডা জল। খেলা চলবে এক পক্ষ হেরে না যাওয়া পর্যন্ত। এক সময় সেই সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। বালকের দলে বালক বাদে সবাই ‘মোর’। বিপক্ষে সুধাংশুশেখর মানে খোকন সহ চার জন জ্যান্ত। বালকের ডাকের পালা। সে ‘ডু ডু’ করতে করতে বিপক্ষের ঘরে ঢোকে। খোকন আচমকাই বাঘের মতো লাফিয়ে তার কোমর জাপটে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য তিন জনও। বালির উপর উপুড় হয়ে পড়ে বালক। তার ডান পা খোকনের দুই পায়ের মধ্যে সাঁড়াশির মতো ধরা। তখনও দম আছে বালকের। ঘাড় তুলে দেখে, নিজেদের সীমানা থেকে মাত্র ইঞ্চি দুয়েক দূরে পড়ে আছে তার বাড়ানো বাঁ হাত। খোকনসহ ওদের তিনজন জ্যান্ত খেলুড়ে বালককে চেপে ধরে আছে। বালকের বুকে এখনও আছে খানিক দম। ওই দুই ইঞ্চি পেরিয়ে যদি তার বাড়ানো হাত ছুঁয়ে দিতে পারে সীমারেখা, উলটে যাবে দান। ওই চারজনকে ‘মোর’ করে বালক একাই জিতিয়ে দেবে তার দলকে। মরিয়া চেষ্টায় নিজের শরীরে মোচড় দিয়ে বাঁ হাত এগিয়ে দিতে চায় বালক সীমারেখার দিকে। ইঞ্চি খানেক এগোতেই খোকনের দুই পায়ের মাঝখানে থাকা তার ডান পায়ের ভেতর থেকে খট করে একটা আওয়াজ ওঠে। যন্ত্রণায় চমকে ওঠে নিঃশেষ হয় বুকের মধ্যে ধরে রাখা দম। সীমারেখা ছুঁতে পারেনি তার আঙুল। হেরে গেছে বালকের দল। হৈহৈ করতে করতে সবাই উঠে গিয়ে দহের ঠান্ডা জলে লাফিয়ে পড়ে। বালক পড়ে থাকে বালির উপর উপুড় হয়ে। একা।

বেশ কিছুক্ষণ পরে প্রথম খেয়াল করে অনাদি। বালক এখনও বালিতে পড়ে আছে কেন? হেরে যাওয়ার দুঃখে? সে জল থেকে উঠে আসে তার কাছে। বলে, –কিরে, উঠ।

বালক বলে,–ডান পায়ে বেদম ব্যথা।

অনাদি তাকে তুলে বসায়। বালকের একটা হাত নিয়ে নিজের কাঁধে বেড় দিয়ে বলে,– এবারে দাঁড়া তো দেখি।

অনাদির কাঁধে ভর দিয়ে বাঁ পায়ে দাঁড়ায় বালক। তারপর ডান পা পাততে যায় বালিতে। অমনি গোড়ালি আর হাঁটুর মাঝামাঝি জায়গার হাড়টা নীচের দিকে খচ করে নেমে গেল মনে হয়। যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে আর্তনাদ করে ওঠে সে, –হাড়টাই ভেঙে গেছে রে!

অনাদির কাঁধে ভর দিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। অনাদি দহের দিকে মুখ ফিরিয়ে জোরে হাঁক দেয়, –খকন্না তাড়াতাড়ি আইস্য হে, অদ্ধুর পা ভাইঙ্গে গ্যাছে!

জল থেকে একে একে উঠে আসে সবাই, সকলের আগে খোকন। বালকের পা ফুলতে শুরু করেছে। খোকন তাকে পিঠে তুলে নেয় অনায়াসে। প্রায় ছুটতে ছুটতে উঠে পড়ে নদীর খাড়া পাড়ে। একটু আগেই যে পথ দিয়ে অহিভূষণের হাতে ঝুলতে ঝুলতে চলে গেছে ডানা-ভাঙা বালিহাঁস, সেই পথ দিয়েই খোকনের পিঠে এখন ঝুলতে ঝুলতে চলেছে পা-ভাঙা বালক। অসহ্য ব্যথার মধ্যেই সেই কথাটি মাথায় আসে তার। হাঁসের নরম তুলতুলে গলার স্পর্শ যেন সহসা ফিরে আসে তার হাতে। এই হাত দিয়ে সেই তো ধরেছিল অসহায় প্রাণীটাকে। সেটা কি পাপ? এটা কি শাস্তি?

ঠিক যেখানে দিদিগোসাঁই দিনরাত থাকতেন, হুকুম-ফৈজত করতেন আর রামায়ণ-মহাভারত পড়তেন, শানপিড়ার ঠিক সেই জায়গায় একটা দড়ির খাটে শোয়ানো হয়েছে বালককে, ডান পা একটা বালিশের উপর রাখা। সেই পা ফুলতে ফুলতে ক্রমশ কলাগাছ। কলুপাড়ার সতীশ গরাইকে খবর দেওয়া হয়েছে। হাড় সরে গেলে সতীশ কাকা তাকে জায়গামতো বসিয়ে দিতে পারেন, দরকার হলে বাঁধন দিয়ে দেন। ছোটোখাটো চেহারার ঠান্ডা মাথার মানুষ। বালকের পা পরীক্ষা করতে বেশি সময় নিলেন না। বললেন, ভালোমতো হাড় ভেঙেছে। তিনি কিছু করতে পারবেন না। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

হাসপাতাল মানে গড়বেতা। পনেরো ষোল মাইল রাস্তা। হুমগড় থেকে বিকেলের বাস ছেড়ে চলে গেছে। এখন গরুর গাড়ি ছাড়া উপায় নাই। এখন গাড়ি জুড়লে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত। রাতের বেলায় গিয়ে কোনো লাভ নাই। তাচ্চেয়ে ভোর তিনটায় গাড়ি জুড়লে সকাল সকাল হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়া যাবে। শশীকাকাকে খবর দেওয়া হলো। তাঁর মতো গাড়োয়ান খুব কমই দেখা যায়। হেলে(গাড়ি টানার বলদ)-রা তাঁর কথা পরিষ্কার বুঝতে পারে, তাঁকে মানেও খুব। শশীকাকা সন্ধেবেলা এসে গাড়িতে পুরু করে খড়ের বিছানা করলেন, চাঁচ(ছই) লাগালেন। এই বাড়ির দুই বিখ্যাত হেলে, মাথা গরম আঁড়রা আর ঠান্ডা মাথার পবনের গায়ে হাত বুলিয়ে, বোধ হয় রাত থাকতে বেরোতে হবে সেকথাটিও তাদের বলে দিয়ে তিনি বাড়ি গেলেন। ঠিক হয়েছে শশীকাকা ছাড়াও গাড়িতে বালকের সঙ্গে থাকবে খোকন। আর চন্দ্রশেখর ঘণ্টাখানেক পরে সাইকেল নিয়ে রওনা দেবেন।

মা শুয়েছেন পাশটিতে। ফোলা পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ঘুমিয়ে পড়ছেন মাঝে মাঝে। অসহ্য বেদনা সইতে সইতে ঝিমুনি আর তন্দ্রার ফাঁকে ফাঁকে দিদিগোসাঁইকে দেখতে পাচ্ছে বালক। তিনি সুর করে মহাভারত পড়ছেন –

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।

হাফ প্যাডেলের কাল
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ
................................................
আসছে আগামী শনিবার

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।