হাফ প্যাডেলের কাল।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।।

প্রায় প্রতি বর্ষায় বন্যার সময় এক দিকের পাড় ঘেঁষে প্রবল ঘূর্ণি জাগে আর সেদিকের পাড় ভেঙে বালি তুলে নিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে নদীর তলদেশ পনেরো - কুড়ি ফুট গভীর হয়ে যায়। বন্যার জল সরে যাওয়ার পরও গভীর নীল জল সেখানে টলটল করে। তার নাম 'দহ', সবাই বলে দ'। কুড়ি - পঁচিশ ফুট উঁচু পাড়ের উপর থেকে দায়ের গভীর জলে ডিগবাজি দিয়ে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কাটা যেসব ছেলেদের খুব প্রিয়, তাদের মধ্যে বালকও একজন। গ্রামের সব ছেলেরাই একসঙ্গে চানে যায়, সবাই পাড় থেকে না লাফালেও সাঁতার কেটে হুটোপুটি করায় কেউ কম যায় না। এক প্রস্থ সাঁতার হয়ে গেলে বালির চরে দুটো টিম করে হাডুডু খেলা হয়। খেলা শেষে আবার সাঁতার, তারপর বাড়ি ফেরা।

এবার গ্রীষ্মে দ'য়ের জল ঘেঁসে একদিকের বালির চরে প্রচুর লম্বা লম্বা ঘাস হয়েছে। প্রায়ই সেখানে বালি হাঁস নামছে। বালি হাঁসের মাংস নাকি খুব ভালো খেতে। বালকের বাড়িতে বা বামুন পাড়ার কোনো ছেলে মাংস খায় না। কিন্তু মেয়েরা তো খায়। বালকের বিয়েওলা দিদিরা বাপের বাড়িতে এলেই গোয়ালঘরে পোষা ষাঁড়া (পুরুষ) হাঁস রান্না করে খায়। বালি হাঁস নেমেছে শুনে বৌদিরাও মনে হয় মাংস খাব বলে ফিসফিস করেছে। অহিভূষণ তাই বন্দুক খুলে পরিষ্কার করতে বসেছেন। চন্দ্রশেখরের নামে দোনলা জার্মান বন্দুক। কিন্তু পাখি মারতে হলে ছররা গুলি দিয়ে মারাই সুবিধে। এই বন্দুকে গুলি চালানোর সময় উলটো দিকে ধাক্কা মারে। বন্দুকের কুঁদো কাঁধে ঠেকিয়ে সেই ধাক্কা সামলাতে হয়, নইলে কেলেংকারি হতে পারে। আজ দায়ে চান করতে নামার আগে হাঁস শিকার হবে। বন্দুক কাঁধে অহিভূষণের পিছু পিছু চলেছে গাঁয়ের পুরো সাঁতারবাহিনী।

নদীর উঁচু পাড়ের কোলে দ'। দ'-এর ওপারে ঘাসের জঙ্গল। সেখানে চরে বেড়াচ্ছে এক ঝাঁক বালিহাঁস। পাড়ের একটা বাবলা গাছের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসে বন্দুক তাক করেছেন অহিভূষণ। সাঁতার বাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে-বসে আছে, সকলের মুখে কুলুপ, চোখ ঘাসের জঙ্গলে। 'গুডুম' করে আওয়াজ, নড়ে উঠল ঘাসবন। পোষা হাঁসের মতো প্যাকপ্যাক করে না বালিহাঁস, সামান্য ডানার আওয়াজ করেই এক ঝাঁক সবেগে উড়ান দিল আকাশে। একটাই কেবল, উড়তে উড়তে ঝুপ করে পড়ে গেল দহের জলে। আবার ওড়ার চেষ্টা করল, একটু উঠেই আবার জলে পড়ল । অহিভূষণ চেঁচিয়ে বললেন— ডানায় ছররা লেগেছে।

অমনি ঝুপঝাপ করে পুরো বাহিনী লাফিয়ে পড়েছে দহের জলে। হাঁসটা টুপ করে ডুব দিল জলের গভীরে। কিশোর জোয়ান মিলিয়ে বারো চোদ্দ জন এক দিকে, অন্য দিকে একা সেই ডানা ভাঙা হাস। শুরু হয়েছে ডুব- সাঁতারে লুকোচুরি খেলা। বালকও স্বাদ পাচ্ছে এই নতুন মজার খেলার। সে ভাবার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না যে খেলাটা এক পক্ষের। হাঁসটির কাছে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা। অনেক ক্ষণ জলের ভেতরে থাকতে পারে হাঁস কিন্তু বাঁচার শ্বাস নিতে তাকে উঠতেই হচ্ছে জলের উপর। তখনই তাকে লক্ষ্য করে তিন-চার জন ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার উপরে। ক্রমশই দম ফুরোচ্ছে তার। অবশেষে ধরা পড়ল বালকের হাতেই। ধরা দিল যেন। ডুব থেকে ভেসে উঠল সাঁতাররত বালকের একেবারে বুক ঘেঁসে, তার মৃদু আন্দোলিত দুই হাতের ঘেরে। এক হাতে হাঁসের গলা টিপে ধরে বিজয়ী বীরের মতো বালি চড়ায় উঠে আসে বালক।

এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে জীবন্ত বালিহাঁস ঝুলিয়ে বাড়ির পথ ধরেন অহিভূষণ। সাঁতার বাহিনী হাঁসের কথা ভুলে বালির চড়ায় হাডুডু খেলার জন্য তৈরি হয়। দুটো দল, বিভিন্ন মাপের ছ'জন করে খেলুড়ে এক একটা দলে। মাথার উপর চড়া রোদ, পায়ের নীচে গরম বালি। তা হোক, দু-পা দূরেই তো দহের ঠান্ডা জল। খেলা চলবে এক পক্ষ হেরে না যাওয়া পর্যন্ত। এক সময় সেই সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। বালকের দলে বালক বাদে সবাই 'মোর'। বিপক্ষে সুধাংশুশেখর মানে খোকন সহ চার জন জ্যান্ত। বালকের ডাকের পালা। সে 'ডু ডু' করতে করতে বিপক্ষের ঘরে ঢোকে। খোকন আচমকাই বাঘের মতো লাফিয়ে তার কোমর জাপটে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য তিন জনও। বালির উপর উপুড় হয়ে পড়ে বালক। তার ডান পা খোকনের দুই পায়ের মধ্যে সাঁড়াশির মতো ধরা। তখনও দম আছে বালকের। ঘাড় তুলে দেখে, নিজেদের সীমানা থেকে মাত্র ইঞ্চি দুয়েক দূরে পড়ে আছে তার বাড়ানো বা হাত। খোকনসহ ওদের তিনজন জ্যান্ত খেলুড়ে বালককে চেপে ধরে আছে। বালকের বুকে এখনও আছে খানিক দম। ওই দুই ইঞ্চি পেরিয়ে যদি তার বাড়ানো হাত ছুঁয়ে দিতে পারে সীমারেখা, উলটে যাবে দান। ওই চারজনকে 'মোর' করে বালক একাই জিতিয়ে দেবে তার দলকে। মরিয়া চেষ্টায় নিজের শরীরে মোচড় দিয়ে বাঁ হাত এগিয়ে দিতে চায় বালক সীমারেখার দিকে। ইঞ্চি খানেক এগোতেই খোকনের দুই পায়ের মাঝখানে থাকা তার ডান পায়ের ভেতর থেকে খট করে একটা আওয়াজ ওঠে। যন্ত্রণায় চমকে ওঠে নিঃশেষ হয় বুকের মধ্যে ধরে রাখা দম। সীমারেখা ছুঁতে পারেনি তার আঙুল। হেরে গেছে বালকের দল। হৈহৈ করতে করতে সবাই উঠে গিয়ে দহের ঠান্ডা জলে লাফিয়ে পড়ে। বালক পড়ে থাকে বালির উপর উপুড় হয়ে। একা।
.
.
.
হাফ প্যাডেলের কাল
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
.
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
.
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
.
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা 

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।