রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত জয়া মিত্রের উপন্যাসিকা ' রাস্তার শুরু ' পড়ে লিখেছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
...............................................
বহমান বাক্যধারা যেন রেখার আঁচড়ে পুরনো দিনের কার্শিয়াঙের ছবি এঁকে চলেছে। ছবির কেন্দ্রে মা, তাঁর তিন সন্তান, তিতির তিন্নি বুবুল এবং ‘বন্দী রাজকন্যা’ যশোদা দিদি, যে পালিয়ে এসেছে দুষ্টু রাজার কাছ থেকে। সে সুন্দর নাচে, শুধুই হাসে, আর বাড়ির অনেক কাজ করে দেয়। 
তিতিরের আবৃত্তি, তিতিরের অঙ্কভীতি, বড়োদের কথা কিছু অন্য রকম, সে কথা টানে তিতিরকে, সে সপ্তম শ্রেণি। কুমারসম্ভবের হিমালয়-সৌন্দর্যের সঙ্গে যে অন্য কথাও আছে, সেটা কি পড়া উচিত তিতিরের? তিন্নি ডানপিটে, তিন্নি খেলাপাগল, প্রতিটি কুকুরের সঙ্গে তার গাঢ় বন্ধুতা, বুবুলের সঙ্গে তার নিঃশব্দ মারামারি, তার ‘বিদ্যা করতে’ ভালো লাগে না। বুবুল শান্ত, বুবুল চুপচাপ, তিন্নি খেলতে খেলতে মজা করে একটু লুকোলেই তার কান্না। 
আর মা। কতো যে তাঁর রূপ! ইজিচেয়ারে বসা বই-পড়া বা উল-বোনা মা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাইতেও বেশি শুনতে-মিষ্টি গান-গাওয়া মা, কালীঠাকুরের সঙ্গে মা, রাগ করে কথা না-বলা মা; আবার পরীতে তুলে নিয়ে যাওয়া ঘুমন্ত তিতিরের হিমশীতল দেহকে বা পাহাড়ে পথ-হারানো সুন্দরকাকাকে শুশ্রূষা করা মা। 
‘শৈলাবাস’ নামের এই বাড়িটির ইতিহাস যাই হোক তাকে ঘিরে থাকে কার্শিয়াঙের পাহাড়-প্রকৃতি, তার ফুলের সমারোহে তিন্নির ‘পাউডার ফুল’ আর ‘ডিউ ড্রপস’; আর পথের শুরু থেকে পাকদণ্ডী পথ আর ‘চোরবাটো’, আছে মন্টিভিয়ট রোড, পথশুরুর আগে সেই এক ঝরনা। আর আছে অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা। 
তাদের স্বল্প কিন্তু অনিবার্য উপস্থিতি দিয়ে আখ্যানটিকে নিটোল করতে আসছেন ‘উপরের ঠাকুমা’, তিতির-তিন্নি-বুবুলের বাবা, চিরকাকা, সন্ধ্যাদি, জনাদা, দিলীপদা, পুলুদি, আম্মা, মুকুপিসি, মীনাদি, ঢকনি দাজ্যু, এমনকি ‘বজু’ আর ‘বাজে’ও। সবাই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। 
আর আছে থিয়েটার, নাটক গান, আবৃত্তি আর অভিনয়ের সাত-সতেরো। সকলের চোখ এড়িয়ে তিতির-তিন্নির নিঃশব্দ চুলোচুলি ড্র করার অনবদ্য কৌশলও কম যায় না অভিনয়ের থেকে। 
চলে যাওয়ার শুরুটা দিয়েই শেষ হয় গীতিকবিতার মতো এই আখ্যান। দিলীপদার চলে যাওয়া, আপেলের চলে যাওয়া – সে এক রকমের যাওয়া। আবার কার্শিয়াঙকে ছেড়ে তিতিরদের চলে যাওয়া আর এক রকমের যাওয়া। দু রকমের যাওয়ার দু রকমের দলা পাকানো কষ্ট বুকে চেপে শুরু হয় তিতিরদের চলে যাওয়া। পড়ে থাকে দূরবিন দারা, তিনধারিয়া, পাগলাঝোরা। 
অনেক লিখতে হয় জয়া মিত্রকে। লিখতে লিখতে লেখনীতে জরা আসার কথা। বহু যুগের ওপার থেকে কোন বাতাসে ভর করে এমন তাজা অনুপুঙ্খ কার্শিয়াং ছবির মতো উঠে এল, তিতিরের হাসিকান্না সমেত, যার একটি শব্দও এক চুল এদিক ওদিক করা অসম্ভব? এক দমে পাঠককে বয়ে নিয়ে যাবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই আশ্চর্য, মোহময় আখ্যান? কোনো উত্তর আছে, তিতির?

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।