বীরেশ্বর সামন্ত হত্যা রহস্য।। শাক্যজিৎ।। শারদ নির্মুখোশ ১৪৩০।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

নির্মুখোশ শারদ ১৪৩০-এ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য' পড়ে লিখেছেন সায়ন্তন সেনগুপ্ত। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.................................................................................................

উপন্যাস - বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য
লেখক - শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
পত্রিকা - নির্মুখোশ শারদ ১৪৩০
পরিবেশক - সুপ্রকাশ 
মুদ্রিত মূল্য - ৩৫০ টাকা 

বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য। হত্যা রহস্য ! নাকি রাজনৈতিক উপাখ্যান ? " শেষ মৃত পাখি " - এর পর আমার পড়া শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় উপন্যাস। এবারের প্রেক্ষাপট রাজ্যের দক্ষিণতম অংশে । যেখানে নদীগুলো ভেসে যায় সমুদ্রের ডাকে সাড়া দিতে । নৌকায় যেতে চোখে পড়ে গগনচুম্বী ইটভাটার চুল্লি । মাঝেমাঝে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে বিষন্ন কালো ধোঁয়া । নদীর ধারে চোখে পড়ে ম্যানগ্রোভের বিক্ষিপ্ত  উপস্থিতি । পাওয়া যায় সুন্দরবনের প্রথম আভাস। কাকদ্বীপ থেকে কুলপির মধ্যে কোনো এক গ্রাম আর মফস্বলের মাঝামাঝি জনপদ। 
উপন্যাসের শুরুতেই পাওয়া যায় মৃত ব্যক্তি আর সম্ভাব্য হত্যাকারীর পরিচয় । হত্যাকারী পূর্বেই  ঘোষণা করেছে  ঘটতে চলা এই হত্যাকাণ্ডের।  ঘোষণাটা জরুরী । কোথাও গিয়ে এই স্পর্ধাটা জরুরী তার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য। 
 " ভূমি সংস্কার " - শব্দটার সাথে আমরা , যারা আশির দশকে জন্মেছি ,পরিচিত হয়েছি  রাজনৈতিক দলের দেওয়াল লিখনে , নির্বাচনী  বক্তৃতায় এবং শেষমেশ পাঠ্যপুস্তকের পাতায় । জেনেছি এদেশের মধ্যে ভূমি সংস্কারের সফলতম রূপায়ন হয়েছে যে রাজ্যগুলিতে তার মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু তার পিছনে কৃষক আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা আছে  , যার উৎস তেভাগা বা  তারও আগে সেই কাহিনী আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে এই উপন্যাসের সাথে ।
এই কাহিনী সামন্তদের , এই কাহিনী বাগালদের।  একদিকে যোগেশ্বর , বীরেশ্বর , সর্বেশ্বর সামন্ত। অন্যদিকে ভীষ্ম , ভীম , দেবু বাগালের কাহিনী । শোষক ও শোষিতের চিরন্তন সমীকরণ। শোষকের রুপ বদলে যায় প্রজন্মান্তরে । জোতদার - ব্যবসায়ী - রাজনৈতিক প্রভু । শোষিতেরও বদলায় ভাতুয়া থেকে ছোট বর্গাদার হয়ে আবার প্রায় জমিহীন দিনমজুর। অর্থনীতির নিরিখে দুতরফের অবস্থান বদলায় না এই আখ্যানে ।
এই কাহিনী নকুল কাঁটালের। সেই কবে পার্টির কাজ নিয়ে এসেছিলো এই জনপদে । তারপর রয়ে গেল এখানকার মানুষ হয়েই। তাঁর স্মৃতি  কৃষক সভার  উত্তাল আন্দোলন , পার্টির ক্ষমতায় আরোহণ , ক্ষমতাসীন অবস্থায় আপোষ ও ক্ষমতা চ্যুতির ইতিহাস ধারণ করে । আজ জীবন সায়াহ্নে এসে সে হয়তো নিরাসক্ত। অপমৃত্যুও তাঁকে আর সেভাবে নাড়া দেয় না ।
শোষকের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হলে তার আধিপত্যকামীতা কী আর শুধু  দুর্বলের শ্রম , জমি গ্রাসে মেটে ! সে হাত বাড়ায় তার নারীর দিকে । তাই সপ্তমী - রোহিণীদের যেতে হয় সামন্ত বাড়ির ভেতর ঘরে । তাঁদের অসহায়তা , তাঁদের দীর্ঘশ্বাস জেগে থাকে দৈব অভিশাপের মতো । তাঁরা না থাকলে নিঃসন্দেহে এই কাহিনীর পরিণতি অন্য খাতে বইতো ।
তাহলে কি এই কাহিনী রহস্য উপন্যাস নয় ? রাজনৈতিক উপাখ্যান ! আমরা যা দেখি , যা বুঝি তার অন্তরালেও অনেক সময় চলে সমান্তরাল কাহিনী । আর সে রহস্য জানতে গেলে তো পড়তেই হবে এই উপন্যাস। 
" শেষ মৃত পাখি " -এর মতোই পরিবেশের বর্ণনায় লেখক তাঁর  মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন এই উপন্যাসেও।  কলমের জাদুতে জড়িয়ে পড়তে হয় চরিত্রগুলোর  সাথে । উপন্যাস শেষ  হয় দেবু , পল্টু , সপ্তমী বা রোহিণীর জীবনের কিছু সম্ভাব্য পরিণতির আভাস দিয়ে । তাতে মূল কাহিনীর বিশেষ কোনো ক্ষয় - বৃদ্ধি না হলেও  পাঠকের মনে রেখে যায় এক  ছোট গল্পের রেশ।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।