স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন।। জয়া মিত্র।।

তুমি বলছিলে কাজের জায়গায় লোকেরা তোমাদের খারাপ ভাবে দেখত? যমুনার কথাটা কারিয়াপ্পার কাছ থেকে শুনে নিয়ে একটু চুপ করে থাকে চিরি। তারপর বলে,

—সবাই জানত আমরা দেবদাসীদের মেয়ে, নাগহল্লি থেকে সাভাদাত্তি থেকে নীরহল্লি থেকে এসেছি। মেয়েরাও আমাদের কথা মন দিয়ে শুনত না। উল্টে আমাদের বাজে বাজে কথা জিজ্ঞেস করত।

—ও! তো তোমরা তোমাদের অফিসারদের কাছে সাহায্য চাইতে না কেন? 

এবারে চিরি একটু উত্তেজিত ভাবে অনেক কথা বলে যায়। শেষদিকে কারিয়াপ্পা তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে,  'ও বলছে অফিসাররাই সবচেয়ে খারাপ ছিল। সিডিপিও-র রিপোর্ট খারাপ থাকলে আমাদের চাকরি চলে যায়। সেজন্য সব মেয়ে সিডিপিওর কথা শোনে। ও আমাদের হুকুম দিত কবে কোন অফিসারের বাড়ি রাতে যেতে হবে।'

যমুনা এতটা ভাবতে পারেনি। সে স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে খানিকক্ষণ, চিরিও মাথা নিচু করে থাকে। তারপর যমুনা আস্তে আস্তে চিরিকে জিজ্ঞেস করে, আর তোমরা যেতে?

এবারে অবাক, কারিয়াপ্পা কথাটা অনুবাদ করার আগেই চিরি মাথা নাড়ে। তারপর মাথাটা আরও নিচু করে নেয়। যমুনা যেন কিছুটা ভয়ে ভয়ে জিগেস করে,— স্বর্ণাভা? 

এবারও কারিয়াপ্পা কিছু বলবার আগেই চিরি ঝট করে সোজা তাকায়। খুব জোরে মাথা নেড়ে বলে ওঠে, ― নো নো সোনাব্বা নো।

তারপর আবার সে দ্রুত কথা বলতে থাকে, তার চোখ গর্বে যেন দপদপ করে ওঠে, কারিয়াপ্পা বলে,—সোনাব্বাকে ওরা কখনো খারাপ কাজ করাতে পারত না। সোনাব্বা কাউকে ভয় পেত না। সোনাব্বা যেখানে কাজ করত ওখানে সবাই সোনাব্বাকে ভালোবাসত। ওখানেই আগে লোকেরা খারাপ কথা বলত, কিন্তু সোনাব্বা যে কেমন করে ওদের বোঝাত। সবাই সোনাব্বাকে আক্কা বলতে শুরু করেছিল। অন্য অঙ্গনবাড়ি মেয়েরাও সোনাব্বাকে ভালোবাসত, সোনাব্বা ওদের অসুবিধার কথা নিয়ে তর্ক করত। অফিসার রাগলে ও-ও রেগে যেত।

যমুনা বুঝতে পারছিল স্বর্ণাভাকে এরকমই হতে হবে। যার তেজ এতখানি তাকে ভাঙবার জন্যই তো অতখানি নীচ নৃশংসতার দরকার হয়। প্রথম রিপোর্টের পর ব্যাঙ্গালোর আসার সময় খেরকার তাকে যে প্রেস কাটিংগুলো দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ‘হিন্দু’তে জানকী আয়ারের করা একটা ছোট স্টোরি ছিল। জানকী লিখেছিল 'আনটিল শী ব্লেড টু ডেথ'। যমুনার মাথায় পেরেকের মত গেঁথে আছে শব্দকটা। দু একজন ডাক্তারকে সে জিজ্ঞেস করেছিল ধর্ষিত হতে হতে মরে যেতে হলে শরীরের ভেতর কি হয়?

শুনেছিল যোনির দেওয়াল ছিঁড়ে ভেতরের শিরা ছিঁড়ে যেতে পারে, ইউটেরাসে ভয়ংকর চোট লাগতে পারে। এসবের সঙ্গে তীব্র মানসিক শক্‌ও মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত চাপে শ্বাসনালী বা অন্য কোন অঙ্গ মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই অকল্পনীয় যন্ত্রণা পাবে মেয়েটি মরবার আগে।

—কেন? শুধু নিজস্ব একটা পরিচয় চাওয়ার অপরাধে?

—“শী ব্লেড টু ডেথ।’

—নারী শরীরের সম্ভোগ, না নারী শরীর হবার শাস্তি?

চিরি মাথা ফিরিয়ে বিদ্যার দিকে তাকিয়েছিল। চৌকি ধরে এক পা দু'পা করে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছে স্বর্ণাভার মেয়ে।

যমুনা চিরিকে বলে তুমি স্বর্ণাভার সব কথা আমাকে বলবে? তোমাদের ছোটবেলাকার কথা?

চিরির একটানা গলার স্বর জলের মত। একটু পর পর চিরির থেমে যাওয়া আর কারিয়াপ্পার গলা, সে যেন আর আলাদা আলাদা থাকে না, একটানা ছন্দ ধ্বনির মত হয়ে যায়। রায়চুর জেলার কুস্তাগী তালুকের এক কোণে এক শক্তিময়ী দেবীর মন্দির আর ছোট শুকনো এক জনপদ। সন্ধ্যাবেলা প্রায় প্রতিদিন সেখানে আসে ধনশালী লোকজন। দিনের বেলা সেখানে খাবার জল পাওয়া যায় না। খেতের মাটির ওপর মরীচিকা কাঁপে। গ্রীষ্মকালে জন্মানো বাচ্চা আর মা জলের অভাবে মরে যায়। সেখানে সোনারবরণ একটি মেয়ে অন্তত একদিন তার মাকে বলেছিল, আম্মা, নানাগে থুম্বা সুস্থ তাগিদে– মাগো আমি বড় ক্লান্ত, আমাকে কিছু খেতে দাও, দায়াভিত্তু ইয়েনারু থিম্মু ভিডিকে কোদু।


স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন

জয়া মিত্র

প্রচ্ছদ : কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।