স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন।। জয়া মিত্র।।

বিভাবতী জানা তার সঙ্গে আলাদা করে খারাপ ব্যবহার করেননি কখনও। বরং তার সামনেই মিসেস সায়গলকে, যাঁর তখনও নামও জানত না জানকী, বার বার বলেছিলেন, তাকে হোম থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা। বলেছিলেন, দেখুন এ মাইনর নয়, কোর্ট একে জোর করে বাবার কাছে পাঠাতে পারে না। কিন্তু এখানে পড়ে থেকে এ নষ্ট হয়ে যাবে। পচে যাবে। পড়াশোনা জানে, বুদ্ধি আছে, স্বাস্থ্য ভালো, একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতার পর ট্রমার মধ্যে আছে, চিকিৎসা হলে ভালো হয়ে যাবে। আঠেরো বছর বয়স। ও নিজে যেতে চাইলে, আপনি কোর্টে আন্ডারটেকিং দিয়ে দরখাস্ত করলে হয়ে যাবে। নিজের মত ইংরিজি আর হিন্দিতেই কথা বলেছিলেন তিনি, কিন্তু তাতে তাঁর আগ্রহ বুঝতে অসুবিধা হয়নি, জানকী আসবার আগেও যে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে সেটাও স্পষ্ট ছিল। হোমের ওই প্রায় একবছর যেন একটা বিরাট ইরেজারের মত জানকীর আগের জীবনটাকে একেবারে ঘষে ঘষে মুছে দিয়েছিল। তাকে হোম থেকে বারে বারে নিয়ে যেত, কার কাছে? ম্যাজিস্ট্রেটের? বারে বারে একই কথা জিজ্ঞেস করা— মা বাবার কাছে ফিরে যাবে?

কে ছিল সেই মা-বাবা? সে ফিরে যায়নি, স্পষ্টভাবে বলেছিল, 'না যাব না। ওখানে পাঠালে নিজের গায়ে আগুন দেব। আমার মা-বাবা নেই। কেউ নেই।'

সেই 'কেউ নেই' বলতে গিয়ে শ্যামল শান্ত একটি মুখ তার মনে পড়ত, তখনও। আজ আর চেষ্টা করলেও সে মুখ মনে করা যাবে না, কিন্তু তখন সর্বক্ষণ সেই মুখ মনে ভাসত—এ কথা মনে আছে। মা বাবা বলে, ঠাকুমা বলে এই পৃথিবীতে যেন তার কেউ ছিলই না কখনো। এই সরকারি হোমই বুঝি তার জীবনের একমাত্র পরিচয়- কষ্টে অপমানে আতঙ্কে আর প্রবল প্রত্যাখানের মধ্যে। আর হোমেই পচে পড়ে পড়ে থাকবার জন্য সে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিল একরকম। কিংবা তৈরি করবারই বা কী ছিল। জালে ঢাকা গাড়ি করে যাদের সঙ্গে অনেকখানি রাস্তা কোর্টে যেত তাদের কারো সাথে একটা কথাও বলত না। কোন মানেই যেন বেরিয়ে আসত না তাদের কথাগুলো থেকেও। বাকি লোকেদের, মানে যে দুইজন ডাক্তার আর ম্যাজিস্ট্রেট, তাকে বারবার নানা কথা জিজ্ঞেস করত, তাদের সব কথার সব প্রশ্নের উত্তরে ওই একটা কথাকেই ধরে রেখেছিল শক্ত করে। ওই গায়ে আগুন দিয়ে মরার কথাটা। মনে হত সে তো মরে গিয়েইছে, আগুনে পোড়াটা আর এমনকি বেশি হবে। এরকমই ভাবত সেই সতের বছরের মন। ভাবত জীবনে যা কিছু হবার ছিল সব শেষ হয়ে গিয়েছে, এরপর কেবল মৃত্যুই অবশিষ্ট। সে জানত ডাক্তার রিপোর্টে বলেছিলেন তার চিকিৎসা দরকার, জোর করে বাবার কাছে না পাঠিয়ে তাকে হোমেই রাখা হোক। তখনই প্রথম জানকী 'ট্রমা' শব্দটা শুনেছিল। ডাক্তারের রিপোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ তার না জানবার কিছু ছিল না। হোমে বাইরে থেকে আসা প্রতিটা খবরই প্রকাশ্য যৌথ। কারো কাছে আড়াল করে রাখা বা ব্যক্তিগত নয়। আদালতের আসা যাওয়ার রাস্তায় দেখা দৃশ্যের, গুজবের প্রতিটা খবর, পরে তার এক একটা শব্দও, সবাই একসাথে বসে গামলা ভর্তি মুড়ি ফুলুরির মত তারিয়ে তারিয়ে খায়। পরে আবার যে যার একা নিজের ভাগটা চেটে চুষে। বাইরে উঠোনের পুকুরটার মতই তো হোমের ভেতরটা, পচা সবুজ। জানকী দেখত। কোন কিছুতে তার পৃথিবীর কিছু পাল্টাতো না বলে তার পাত থেকে সপ্তাহে একদিনের বরাদ্দ মাছ কিংবা মাসে একবার দেওয়া গায়ে মাখার সাবান কেউ বলে বা না-বলে তুলে নিলে, সে কোনদিন কিছু বলেনি। হয়ত অন্যরা কেউ আপত্তি করেছে। গালাগালি ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, তাকে কোনো পক্ষ সাক্ষী মানতে এলে সে উঠে গিয়ে অন্য কোনো কোণে বসেছে।

কেবল একটা ব্যাপারে সে চিৎকার করেছিল। প্রাণপণ জোরে। রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে থাকা নানাবয়সী মেয়েদের অনেক কিছুই সে দেখত। তার সেই ঝাপসার মধ্য থেকেই দেখত। কিন্তু একদিন রাত্রে ঘুমের মধ্যে তার বুকের ওপর কারো হাত পড়লে সে এমন চিৎকার করে উঠেছিল যে সবাই  ছুটে আসে। মেট্রন, পাহারাওয়ালি সবাই। যে হাত দিয়েছিল সে বুঝতেও পারেনি যে এতো মার কেন খেল। তার সারা গায়ে কি হাত লাগায়নি ওই মেট্রনরা নিজেরা? কে আবার না লাগায় এখানে? সে কী করে জানবে জানকীর গলায় এই চিৎকারটা আটকে ছিল একবছর ধরে? সেই পচতে থাকা, বন্ধ থাকা, মানুষদের মধ্যে থেকে থেকে পচে যাওয়াকেই মেনে নিয়েছিল জানকীরও প্রায় আঠেরোর আয়ু, যতদিন না দুপুরবেলা হোম সুপারের ঘরে দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসা মিসেস অনুরাগ সায়গল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, — যাওগী বেটি মেরে সাথ?
.
.
স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন
জয়া মিত্র
.

প্রচ্ছদ : কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা
.
সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।