বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া। সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

'চুনু হজমিওয়ালা তার কাঠের ডালাটা নিয়ে চলে আসতো ঠিক বিকেল চারটে নাগাদ। রাসবাড়ির বড়ো গেটটার পাশে তার ডালা সাজিয়ে বসতো। সাজানোর তেমন কিছু ছিল না যদিও। বড়ো বড়ো কাচের কয়েকটা বোয়াম, বিট নুনের কৌটো। আলুকাবলি মাখার একটা ছোটোখাটো এনামেলের গামলা। এইসব ছোটোখাটো টুকিটাকি আর কী।
যেসব বাচ্চারা ঘড়ির ছোটো কাঁটাটা চারের ঘরে আর বড়ো কাঁটাটা বারোর ঘরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করত, তারাই ছিল চুনু হজমিওয়ালার ফার্স্ট কাস্টমার। গ্রীষ্মের সেই বিকেলে খালি পায়ে হাঁটলে পিচের রাস্তা বুঝিয়ে দিত ছ্যাঁকা কাকে বলে। তবুও বিকেলে মাঠে যাওয়ার তাড়া ছিল সবার। একটু আগে গেলে খেলার সময়টা অনেক বেশি পাওয়া যায়। দল বাড়ানো যায়। লুকোচুরি খেলায় চোর হলে তাড়াতাড়ি ধরা হয়ে যায় সবাইকে। ধাপ্পা খাওয়ার তেমন আর ভয় থাকে না। তাছাড়া আরও একটা সুবিধে হয়, রাধারমণের 'বৈকালিক' পাওয়া যায়।
এই সময় বিকেলে শিব মন্দিরে আলাদা করে পুজো হয়। আর কয়েক দিনের মধ্যে শিব বিয়ে করতে যাবেন বলে কথা! তোয়াজ করতে হবে না! ওদিকে প্রধান পুরোহিত বৃদ্ধ মোহিনীমোহনবাবু রাধারমণকে দুপুরের ঘুম থেকে তুলে ভালো-মন্দ খেতে দিচ্ছেন। বৈকালিকের খাবার সাজানো হয়েছে। পিঁড়ি পেতে জলের গ্লাস দিয়ে সাজানো হয়েছে থালা। তাতে সুন্দর করে সাজানো আছে তরমুজ, মুগের ডাল ভেজা, কলা, শশা, ছানা, একটু মিছরি আর বেশ খানিকটা ভোলাদার কালো গোরুর দুধের মাখন। শুধু তো এগুলো রাধারমণ খায় না। তার এই বিকেলের জলযোগের দিকে হাঁ করে নজর থাকে অনেকগুলো চোখের। বেশ কয়েকটা পেটুক পেটের। তাদের কাছে রাধারমণের এই জলযোগ বড়ো নেশার মতো ঘোর লাগায়। খেলতে আসার পথে উপরি পাওনা হিসেবে মন্দ হয় না। তক্কে তক্কে একটা লম্বা লাইন অপেক্ষা করে থাকে প্রতিদিন। কীর্তন দল ভিড় জমাবার আগেই ওই খাবারগুলো তাদের চাই। কম পড়ে না যেন একটুও।

ভাগ্য যদি ভালো থাকে, সবে বিকেলে আসা রোদে যদি ওই রাস্তা দিয়েতখন গুরুদ্বারে যিনি গ্রন্থসাহেব পড়েন, তাঁর দেখা পাওয়া যায়-- তাহলে তো কথাই নেই।আটাভাজায় অমন যে ঘিয়ের গন্ধ থাকতে পারে, যে না খেয়েছে জানেই না। তারমধ্যে গোটা গোটা চিনিগুলো যেন মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দাঁতের মধ্যে পড়লে কটর মটর আওয়াজ হয়। নড়ে ওঠা পড়বে-পড়বে করা দাঁতটাও যেন কঁকিয়ে হিপ হিপ হুররে বলে ওঠে। গঙ্গার ধারে গুরুদ্বারে হাত পেতে দু চামচ আটাভাজা খাওয়ার পর ঠোঁটের ওপর একটা গোঁফের রেখা তৈরি হয়। দুপুরে রান্নাঘরে গিয়ে হরলিক্স চুরি করে খেলে যেমন হয়, ঠিক তেমন। সেখানে বাড়ির লোকের কাছে বকুনির ভয় থাকে। গুরুদ্বারে থাকে না। বরং গঙ্গার ধারের সেই ছোট্টো  ঘরটার জানলা দিয়ে ওপারের কাচের মন্দির দেখা যায়। ঘনি ছোটো নৌকা নিয়ে কুচো চিংড়ি ধরতে বেরোয় বাবার সঙ্গে। হাতে তার এক ঠোঙা মুড়ি-চানাচুর, কাঁচা লঙ্কা। পাড় থেকে নৌকাটা জলের দিকে একটু ঠেলে দিলে এক খাবলা হাতে চলে আসে। চিবোতে মন্দ লাগে না। এইভাবে টুকটুক করে বিকেলটা জমাট বাঁধতে থাকে। তবে আসলটাই তো এখন বাকি। সেদিকে চোখ ঘোরালেই ছোটো কাঁটা চারের ঘরে আর বড়ো কাঁটাটা বারোর ঘরে দেখতে পাই আমরা। ঢং ঢং করে চারটে বাজার ঘন্টা পড়ে। কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়, রাসবাড়ির গেটের সামনে চুনু হজমিওয়ালা যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। তার মাথার চারপাশে ঈশ্বরের মতো এক জ্যোতির্বলয় দেখতে পাওয়া যায়। বারবার যেন মনে হয়, এই মুহূর্তে দশ পয়সা না হলে জীবন বৃথা। এই জগৎ সংসার মায়াহীন।''

সেই সব মুখরোচক উড়ন্ত বিকেলগুলো
কল্লোল লাহিড়ী

বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া
সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদঃ শোভন সরকার
অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।