বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া। সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

"ট্রেনের দরজা এক ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক অষ্টাদশী তরুণী। প্ল্যাটফর্মে মুখোমুখি দাঁড়ানো তরুণটি সম্ভবত তার পাণিপ্রার্থী। দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে, ওদের মধ্যে 'অ্যাফেয়ার চলছে'। দু'জনে খুব নীচু স্বরে হেসে হেসে কথা বলছেন। তরুণীর নরম হাত পরম যত্নে তরুণের কাছে গচ্ছিত। ট্রেন ছেড়ে দেবে, এই আর মিনিটের তিন-চার বাকি। ওদের হয়ত এবার অনেকদিন পর দেখা হল, এরপরও অনেকদিন আর এত কাছাকাছি আসা হবে না। তখন আর মিনিট দুয়েক বাকি হঠাৎ দেখি তরুণ হাত ছেড়ে কোথায় ছুটে গেলেন। ওমা এত সুন্দর প্রেমের শেষটুকু দেখা হবে না! আফশোস হল। চালক হর্ণ বাজালেন। বেশ লম্বা হর্ণ। এবার ছাড়বে ট্রেন। এমন সময় দেখি সেই তরুণ কোত্থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন। হাতে থার্মোকলের বাটিতে সাদা ধোঁয়া ওঠা সফেদ মোমোর ওপর লাল-সবুজের নকশা -- লঙ্কা আর টমাটোর চাটনি। ট্রেন ছেড়ে দিল। ক্ল্যাইম্যাক্সে তরুণীর হাতে মোমো, দু'জনের দু'জোড়া চোখ শেষটুকু মুছে নিতে চেয়ে অপলক। ব্যাকগ্রাউন্ডে নীল-সাদা রেলিং, সিমেন্টের বেঞ্চ আর টকটকে কমলা সূর্য, মনে মনে গুনগুন "রুক যা না, তুমসে মিলনে কো দিল করতা হ্যায়..."।
রেল স্টেশনের খাবারে যেন এক আলাদা স্বাদ থাকে। তাই তো সকালে যাত্রা শুরুর পূর্বে সুযোগ পেলে যাত্রীরা স্টেশনের দোকান থেকে খেয়ে নেন কচুরি, ডালপুরি, চা, ডিম টোস্ট বা কেক টেক কিছু একটা। সকালে এইসবেরই চল বেশি। ভোর ভোর স্টেশনের উনুনের আঁচ পরে যায়। তারপর বড় গামলায় ময়াদা নিয়ে, বেশ করে ময়ান দিয়ে জুত করে চলে ময়দা মাখা। ওদিকে আলু-মটর কোটা-বাছা-ধোয়া চলতে থাকে। টুক টুক করে হামানদিস্তায় আদা ছেঁচে তোলা উনুনে কড়াই চাপানো হয়। বাতাসে সম্বরার গন্ধ আর কানে ছ্যাঁক-ছোক আওয়াজ। যাত্রীরা কেউ দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন, কেউ নিয়ে ট্রেনে উঠে যাচ্ছেন আয়েশ করে সীটে বসে বসে খাবেন বলে।    
স্টেশনের চা-পাউরুটি-ঘুঘনির দোকানে সারাদিনই টুকটাক ভীড়। বিশেষ বিশেষ সময়ে ভীড় বাড়ে। দুপুরের দিকে কোনও কোনও স্টেশনের কচুরি-ডালপুরির দোকানে এগরোল, স্যান্ডউইচেরও ব্যবস্থা থাকে। দুপুর থেকেই শুরু হয়ে যায় চপ, সিঙাড়া ভাজার প্রস্তুতি। আলু, মোচা, চিংড়ি, ডিম, টমেটো, লঙ্কা, ধনেপাতা, লইট্যা মাছ -- কতকিছুরই না চপ হয়! চাউমিনের পুর ভরে সিঙাড়া ভাজতে দেখেছি রানাঘাটের কাছে হবিবপুর স্টেশনে। সব রেডি করাই থাকে। বিকেল হলে কেবল গরম তেলে ছেড়ে খাদ্যরসিকের প্লেটে তুলে দেওয়ার অপেক্ষা আর কি। সন্ধেবেলা বা রাতে ফিরতি ট্রেনের যাত্রীরা স্টেশনে নেমে বাড়ি ফেরার আগে চপ, ফুলুরি, বেগুনি নিতে ভোলেন না। বাড়ির লোকের আবদার থাকে যে।                  
একেক স্টেশনে একেকটা খাবারের কদর থাকে। এসব খোঁজ বেশি রাখেন নিত্যযাত্রী, বিশেষত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা। মুখে-মুখে সেসব খবর ছড়িয়ে যায় অন্য যাত্রীদের মধ্যে, বয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আবার অনেক সময় কোনও স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে, সেই স্টেশনে যে খাবারের দোকান থাকে, তা থেকে খাবার আনিয়ে ট্রেনে বসে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। এই কাজটি মূলত করেন নিত্যযাত্রীরা। কারণ, স্টেশনগুলোর নাড়ী-নক্ষত্র, কোন জানালায় কোন দোকান পড়বে, কোন দোকানে খাস্তা আলুর চপ ভাজে, কোন দোকানে হাফ ডিমের ডেভিল স্বাদু ও সস্তা - এসব খবর ভরা থাকে তাঁদের অভিজ্ঞ ঝোলায়। দোকানগুলোতেও নির্দিষ্ট কর্মচারীরা তৈরিই থাকেন। ট্রেন ঢুকলেই তাঁরা রেলগাড়ির জানলায় জাবালায় গিয়ে দাঁড়িয়ে খাবারের বরাত আনেন বা প্রথমেই হাতে করে খাবার নিয়ে গিয়ে যাত্রীদের হাতে তুলে দেন ও দাম নিয়ে ফেরেন। যেমন- কাঁচরাপাড়ার নানপুরি, চাকদহের মহিলা কামরার জানালার কাছে কাঁচের শোকেসে সাজানো থাকে গরম-গরম ভাজা চপ, ফুলুরি, ফাটা ফুলুরি, ব্যোম, বেগুনী। সবিতা দি, টুম্পা আর রমারা প্রায়ই হাত বাড়িয়ে চপ কেনেন চাকদা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে। এটা তারা করেন ফিরতি পথের অবসন্নতায়। সকালে ওসব ভাজেও না আর সকালে অন্য উদ্যম থাকে, তখন ভরপেটে ওসব মুখে রোচে না। ভেজে রাখা ফুলুরি ফাটিয়ে আবার বেসনের গোলায় চুবিয়ে ডুবো তেলে ভেজে দিতেন কল্যাণী সীমান্ত স্টেশনের চপ-ফুলুরি বিক্রেতারা। কৃষ্ণনগর থেকে শিয়ালদাগামী সকাল ৭:৪-এর ট্রেনের মহিলা কামরার নিত্যযাত্রী জয়া দি, অনিমা দি'রা রানাঘাট স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে নির্দিষ্ট দোকান থেকে চা আনিয়ে খেতেন, এবং অন্যদের খাওয়াতেন। ছোট ছোট স্টিলের গ্লাস সঙ্গে রাখতেন তারা, ওতেই চলত চায়ের ভাগ-বাঁটোয়ারা। বিস্কুট নিতেন না ওরা সঙ্গে। সাত-সকালে একটু চা না হলে চলে? দুপুরের গেদে কিংবা শান্তিপুর লোকালে চেপে রানাঘাটে এসে ডি এম ইউ ধরার আগে সোমক-দেবোপমরা রানাঘাট স্টেশনের ডিমটোস্টের কেবিনে ঢুঁ মারত। কৃষ্ণনগর স্টেশনে লালগোলাগামী ট্রেন এসে দাঁড়ালে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বা ট্রেন থেকে টুক করে নেমে ইউসুফ-হামিদরা কিনে নিতেন শসার কুচো সস আর কাসুন্দি দেওয়া গরমাগরম কচুরি-ডালপুরি। অনুপম-সোহিনী আবার ওই স্টেশনের মোমোর দারুণ ভক্ত ছিলেন। বাড়ি ফেরার আগে যতটা সময় একসাথে কাটানো যায় আরকি, সঙ্গে কান থেকে ধোঁয়া বের করা ঝাল-ঝাল মোমোর পাতলা স্যুপ।   
দুপুরের স্টেশন শান্ত, অবশ্য নিঝুম নয়। যেন দু'দণ্ড জিরিয়ে নেয়, ঝিমুনি আসে তার। গরমের ক্লান্ত দুপুরে ছোট ছোট ভাঁড়ে দই বিক্রি হতে দেখেছি কল্যাণী স্টেশনে। বৃদ্ধ হকার ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন। আমপানা, লেবুর শরবত রেলগাড়িতেও ওঠে আবার স্টেশনেও পাওয়া যায়। কাঁধে ঝোলানো কাঠের বাক্সের ভেতরে থার্মোকলের পাত বসিয়ে, তাতে বরফ দিয়ে স্টেশনে ঘুরে ঘুরে পেপসি বিক্রি করে কোনও কোনও হকার। ক্লান্ত যাত্রীর পিপাসা মেটে।"

হাত চলে, মুখ চলে, ছুটে চলে ট্রেন
শিপ্রা সরকার

বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া
সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।