বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া। সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

দুপুর রোদে ক্লাসরুমটা তেতে। সিলিং ফ্যানটা ঢিমে তালে ঘুরছে। সবাই মিলে ফুঁ দিলেও ওর চেয়ে জোরে ঘুরবে। উঁচু পাটাতনের উপর পাতা পাটাতনে বসে স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। পড়াচ্ছেন বটে, কিন্তু তিনি হয়ত নিজেও জানেন এসময়ে ছেলেদের পড়ানো বৃথা। মাথায় কিছুই প্রায় ঢুকছে না। স্কুলের ঝিমিয়ে পড়া ফোর্থ পিরিয়ড। টিফিনের ঘন্টা পড়তে সামান্য কিছুক্ষণ বাকি। পিছনের বেঞ্চে একটা ছেলে এর মধ্যেই ঘুমিয়ে কাদা। ব্যাগের উপর মাথাটা এলানো। কেউ আবার কাটাকুটি খেলছে। একজন আবার খিকখিক করে হেসে আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। ঝড়ের পূর্বে যেমন মৃদু মৃদু ঠান্ডা হাওয়া দেয়, ছেলেদের মধ্যে থেকে থেকে কোলাহল উঠছে। একটা হুল্লোড় বার বার বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। স্যার, কোর্টের জজ সাহেবের মতো স্কেলখানি টেবিলের উপর কয়েকবার আছড়ে ছেলেদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। ছেলেরা স্কেল ঠোকার তালে তালে মাথা নাড়তে থাকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য গুঞ্জন মিলিয়ে যায়। আবার শুরু হয়।
অবশেষে আসে মাহেন্দ্রক্ষণ। ঢং ঢং ঢং ঢং ধাতব শব্দ। পরমুহূর্তেই স্কুল বাড়ির উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে যায়। দুদ্দাড় করে ছেলেদের দল ধুলো উড়িয়ে পিলপিল করে বেরোতে থাকে দরজা দিয়ে। কেউ বা আনন্দে বেঞ্চ পিটাচ্ছে । কেউ বেঞ্চের উপর ব্রেক ড্যান্স জুড়েছে। স্কুলের টিফিন টাইম।
ছেলেদের একটা বড় অংশ মাঠের গেট দিয়ে বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। আচারের ঝালমুড়ি দোকানের সামনে জটলা। কয়েকজন টিফিন পিরিয়ড শুরুর আগেই হাজির হয়েছে। আচার ঝালমুড়ি সবার করে এবার মাঠে ব্যাট পিটোবে। এরা নির্ঘাৎ ক্লাস পালিয়েছে। কোনো একসময় ফাঁক বুঝে স্কুলের পিছন দিকের পাঁচিল টপকে বাইরে এসেছে। কোনোদিন যদি অলিম্পিকে পাঁচিল টপকোনোর প্রতিযোগিতা হয়, আমাদের স্কুলের ছেলেরা নিশ্চিত মুখ উজ্জ্বল করবে।

আমাদের স্কুলে পড়েছে অথচ পম্পার আচার খায়নি, তাহলে তার স্কুলজীবনের চোদ্দ আনাই মিছে। স্কুল বসলেই হাজির পম্পার ঠেলা গাড়ি। নামটি 'পম্পার আচার' বটে, কিন্তু আচার ছাড়াও হরেক মনলোভা মনভোলানো পসরা। যে ভদ্রলোক এতসব সম্ভার মেলে বসেছেন, চেহারাটি তাঁর দেখবার মতো। ইয়া দশাসই ষন্ডা মার্কা চেহারা। গায়ের রঙ আবলুশের চেয়ে দু পোচ কম। পালোয়ান মার্কা গোঁফ। এমন চরিত্রের নাম নিশ্চই পম্পা হতে পারে না। পরে শুনেছি ওনার নাম পঞ্চা। ওনার মেয়ের নাম পম্পা।
শুরুটা হোক আলু কাবলি দিয়ে। ওইটুকু ঠেলাগাড়িতে কত যে তাক, কুঠুরি! এক গোপন কুঠুরি থেকে পঞ্চা বার করে আনবে সেদ্ধ আলু। একটানে আলুর বস্ত্রহরণ। তারপর ছুরি দিয়ে আলু কাটা, পেঁয়াজ লঙ্কা টম্যাটো কুঁচি ধনেপাতা, ছোলা সেদ্ধ মেশানো। তেঁতুল জলের পাত্র থেকে একটু খানি তরল চলকে এসে পড়বে আলু মাখার পাত্রে। এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায় পঞ্চা ছড়িয়ে দেবে স্পেশাল মশলা- ক্যানভাসে ফাইনাল টাচ দিলেন। এক দেবভোগ্য শিল্প কর্ম জন্ম নিল। যেন দ্য ভিঞ্চি মোনালিসা আঁকলেন কিংবা বত্তিচেল্লি আঁকলেন ভেনাসের জন্ম।

📘
স্কুল যখন আমরা ছাড়ি, পঞ্চা তখনই বেশ অনিমিয়ত হয়ে গেছিল। নিজে আসত না। ওর ছেলেই আসত। স্কুল ছাড়ার দু-এক বছরের মধ্যে দেখলাম পঞ্চা আসা একেবারেই বন্ধ করে দিল। এতদিন ছেলেই স্কুলের সামনে বসেছে। লকডাউনের আগে পর্যন্তও ওর ছেলের কাছ থেকে আচার কিনেছি। কিন্তু লকডাউন মানুষের জীবন জীবিকা বদলে দিয়েছে। শুনেছি, পঞ্চা এখন বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ম্যাগী, চা, ডিম টোস্টের দোকান দিয়েছে। পঞ্চার ছেলে পঙ্কজ সকালে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। বিকেলে দোকানে বসে। ব্যক্তিগত ভাবে খোঁজ আমি নিইনি। নিতে সাহস হয়নি। স্কুল জীবনে যে মানুষটিকে ঘিরে এত সব সুস্বাদু মুহূর্ত, তাঁকে অন্য কিছু বিক্রি করতে দেখলে স্কুল জীবনের এই মায়াবী দুনিয়াটাই যে চূর্ণ হয়ে যায়! কিন্তু তারও তো পেটের টান। পেটের টান নস্টালজিয়ার মর্ম বোঝে না। প্রতিদিন লড়াই করে বাঁচা সিপিয়া টোনের হিসেব রাখে না। স্কুল তো বন্ধ।  বিকল্প জীবিকাকে আঁকড়ে ধরে যদি ওরা ভালো থাকে, সেটাই পরম নিশ্চিন্তের। পুরনো পেশায় আর হয়ত ওরা ফিরবে না। স্কুল জীবনের আমাদের টক ঝাল মিষ্টি জীবনকথা 'কাহিনি' হয়েই বেঁচে থাকুক। আমাদের বয়স বাড়ছে। চুলে পাক ধরছে। কয়েক যুগ পর, নতুন প্রজন্মের স্কুলের ছেলেদের ডেকে বলব-' জানিস তো, এখানে আমরা পম্পার আচার খেতাম'। তারা কি তখন বিশ্বাস করবে?
আমাদের আচার ঝালমুড়ির গল্পরা বড় 'আনহাইজিনিক'। চোখ জ্বালা করে। গলার কাছটা দলা পাকিয়ে আসে।

স্বাদু দিনের স্বাদকাহন
গৌরব বিশ্বাস

‘টিফিনের ঘন্টা  বাজে’
বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া
সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদঃ শোভন সরকার
অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।