বাঙালির পথঘাটের খাওয়া দাওয়া। সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

গঙ্গা নদীর পাড় ঘেষে আমাদের পাড়া। রিফিউজি কলোনিপাড়া। পাশাপাশি দুটি কলোনি তাদের ফেলে আসা দেশ ও ফেলে আসা সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এ আমার শৈশবে দেখা।
স্বপনকাকার মা ঠাকুমা; যখনই বের হতেন, কোঁচড়ে করে অন্তত খানপাঁচেক পান নিয়ে বের হতেন। বেশ খানিকটা চুন সুপারির সঙ্গে গোপাল জর্দা। দুপুরে খাওয়ার পর একটু পাড়া বেড়ানো ছিল তাঁর অভ্যাস । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। রায় ঠাকুমার বাড়ি, বণিক বাড়ি, এমনি আরও চার-পাঁচ বাড়ি সেরে আমাদের উঠোনে এসে বসতেন। তারপর কোঁচড় খুলে পান মুখে দিয়ে লাল টুকটুকে রসালো ঠোঁট চেটে বলতেন— 'যাই কও ব্যালার মা দিদি, পথে ঘাটে কে বিনা পয়সায় আমার লাইগ্যা পান সাজাইয়া বইয়া থাকব! আমি তাই আমার পথের খোরাক হগল সময় সঙ্গে লইয়াই চলি।’

সাজানো পানই আমার দেখা বাঙালি বা বলা যায় এক হদ্দ বাঙালের পথেঘাটের প্রথম খাওয়া। যদিও এতে পেট ভরে না। সেই অর্থে আহার নয়। কিন্তু মন তো ভরে!

খাওয়ার সঙ্গে যে ঋতুর সম্পর্ক গভীর, আধুনিক বাঙালি সেটা নাও মানতে পারেন। তার ওপর আমাদের জীবন ও জীবিকায় বাংলা মাসের গুরুত্বও ততটা নেই। কিন্তু গরমকালে মানে বৈশাখে যে একটু ঠান্ডা খাবার খেতে হয় তা সবাই জানে। এই সময় পথের ধারে কোনও বট বা পাকুড় বা আম গাছের ছায়ায় বা তার কাছাকাছি কোনও জায়গায় ডাব বিক্রেতাকে দেখলে মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটারের বোতল বয়ে বেড়ানো বাঙালি গাড়ি থামিয়ে ডাব কিনে খায়।
— দাদা একটু কচি দেখে দেবেন। 
পাশের সুবেশা বান্ধবী হয়ত বা বলে উঠল 
— না না দাদা আমারটায় যেন হালকা শাঁস থাকে।

গরমের দিনে বাবা বাজারে গেলে ঠাকুমা বলে দিতেন, 'শংকর তো অনেক রাইত অবধি জাইগ্যা পড়ে, অর আর পোলাপানগুলার লাইগ্যা খানতিনেক ডাব লইয়া আসিস।' আমরা কাঁসার গ্লাসে ডাবের জল খেলেও শংকর মানে ছোটোকাকু ওই ডাবের জল প্লাস্টিকের ওয়াটার বোতলে ভরে নিয়ে ব্যাজার মুখে বাড়ির বাইরে বের হতেন। ওই ডাবের জল তাঁর পথের পথ্যি। তাঁর মায়ের নির্দেশ— 'প্যাট ঠান্ডা থাকব। রাস্তায় কোন উল্টাপাল্টা জিনিস খাইও না। শেষে কিনা আমাশা করব।’
চিরকেলে আমাশারুগী বাঙালি টিফিনকৌটো জলের বোতল সঙ্গী করলেও ট্রেনের কেনা ছাল ছাড়ানো নুনমাখানো বেশ খানিকটা গুঁড়োলঙ্কা ছড়ানো শসা খেয়ে দিব্যি হজম করেও নিয়েছে।
এসময় গরম গরম খাবার খেতে নেই। তাই ব্যান্ডেল টু হাওড়া লোকাল ট্রেনে তরমুজ, বেল এইসব উঠত। মানুষ দিব্যি এইসব কিনে রসিয়ে খেত। এ আমার মামাবাড়ি চন্দননগর যেতে গিয়ে অনেকবার দেখেছি।

আমার ঠাকুরদা খুব পঞ্জিকা মেনে চলতেন। প্রতি বাংলা বছরের শুরুতেই আমাদের বাড়িতে একটা পঞ্জিকা আসত। দাদু বলতেন— 'যানবাহনে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে, ভিজা কাপড়ে, ভিজা মাথায় খাইতে নাই।' এমনটাই নাকি তাঁর পঞ্জিকায় লেখা আছে । আর একটা কথাও বলতেন— ‘ছৌনছার তলায় অর্থাৎ কিনা যেটাকে মিস্ত্রীরা বলেন সানসেট তার তলায় বইস্যাও খাইতে নাই।’
তবে তিনি এত চা-প্রেমী ছিলেন যে আমাকে নিয়ে শেওড়াফুলি যেতে গিয়েও ট্রেনে চা খেয়েছেন। তিনি তাঁর এই ভ্যাবলা নাতনিটিকে চিনতেন।  কথাটা ঠিক ঠাকুমার কানে উঠবে। 'যানবাহনে চা খাইসে’—এ কথা আমি বলবই। তাই তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, 'বইন, চায়ে কোনো দোষ নাই।’

পথের খাবার ও সেই মেয়েটি
রূপা সেনগুপ্ত

বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া
সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

মুদ্রিত মূল্যঃ চারশো আশি টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।