জাফির অ্যাডভেঞ্চার। আহমেদ খান হীরক।

"জাফি ছুটছে।
সমুদ্রের একবারে তলদেশে দিয়ে ছুটছে। যত শক্তি তার আছে তার সবটাই ব্যবহার করছে ছোটায়। তবু মনে হচ্ছে যতটুকু একবারে অতিক্রম করতে চায় তা করতে পারছে না। একবার ভাবল এখন যদি একটা বাইমমাছ পাওয়া যেত তবে তার পিঠে চেপে যাওয়া যেত দ্রুত। বাইমের গতি তো তার চেয়ে বেশি। পরক্ষণেরই জাফি ভাবল, এই ছোটা তার একান্ত নিজের ছোটা। এখন তাকে একা ছুটতে হবে, একাই ছুটতে হবে। এটাই সত্যিকারের জীবন, এবং এটাই বেঁচে থাকা।

সমুদ্রের তলদেশের শৈবাল আজ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। পিঠে লাল ফুটকি দেওয়া একঝাঁক মাছ তার পাশ দিয়ে চলে গেল, অন্যসময় হলে তাদের পিছু নিত, তাদের সাথে কিছুক্ষণ খেলত, আজ তাদের দিকে ফিরেও তাকালো না জাফি। তার এখন একটাই লক্ষ্য— লাল পাথরের চাঁইয়ের কাছে যাওয়া। যত দ্রুত সম্ভব সেখানে পৌঁছানো। সবাইকে সাবধান করে দেওয়া। সেখান থেকে সবাইকে সরিয়ে ফেলা।

কিন্তু জাফি যখন প্রাণপণে ছুটছে ভয়ঙ্কর মানুষগুলো ততক্ষণে লাল পাথরের চাঁইয়ের কাছে আসলে পৌঁছে গেছে। মাঝারি এক নৌকায় তারা এসেছে। দুজন। পানির ওপর থেকেই উবু হয়ে তারা লাল পাথরের চাঁইটা দেখার চেষ্টা করছে। অতিকায় এক লগি দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে পাথরটাকে খুঁজতেও শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে।

এক সময় কোথায় যেন হালকা বাধা পেল লগি। ফলে তারা নতুন করে উদ্যম পেল কাজটায়। লগিটা বারবার একই জায়গায় ঘোরাতে থাকল। শেষে পেয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত সেই বস্তু.... পাথরের চাঁই। লাল পাথরের চাঁই।

মানুষগুলো জানে, এরকম পাথরের দেয়াল ঘেঁষেই শামুক ঝিনুকের বসবাস। এবার তাদের যা করার বাকি থাকে তা হলো লম্বা একটা নোঙর ফেলা। নোঙরের ভারে তাদের মাছ ধরার হালকা এই ডিঙি নৌকাটা স্থির থাকবে। তারপর তারা জাল ফেলবে...

সারাদিন ধরে অনুষ্ঠান হওয়ার পর সবাই ক্লান্ত ছিল। ফলে রাতের খাবার শেষ হওয়ার সাথে সাথেই প্রায় প্রত্যেকই চলে গিয়েছিল ঘুমাতে। লাল পাথরের চাঁইয়ে আজ আর গল্প বলার আসর বসেনি। সারাদিন যথেষ্টই হয়েছে... নতুন করে কারো কোনো গল্প বলার ছিল না। দু-একজন যে জাফির খোঁজ করেনি তা নয়, বিশেষত মহামান্য সুমো। কিন্তু সবাই তাকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে, জাফির এমন স্বভাব নতুন কিছু তো না, নিশ্চয়ই সে আশেপাশে কোথাও আছে। বাইমমাছেরা তার বন্ধু বিশেষ, রাতের খাওয়াদাওয়া হয়তো সেখানেই সেরেছে।

ফলে বলা যায় মাঝরাতের আগেই লাল পাথরের চাঁইয়ে চলছিল নাক ডাকানোর একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা। এ রকম এক নাজুক সময়ে মানুষ দুটো তাদের আক্রমণ করল।

একটা গোল জাল এসে পড়ল ঝিনুকের বাড়ির ওপর। তারপর কাঠির ভারে জালটি ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে বসে যেতে থাকল পাথরের ওপর জমা বালির আস্তরণে। এসবের কিছুই টের পেল না লাল পাথরবাসীরা।

টেরটা পেল জালের প্রথম হাঁচকা টানে। ধড়ফড় করে উঠে বসল তারা। কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না কী হচ্ছে। যখন বুঝল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবু কেউ একজন গিয়ে সাইরেনটা বাজাতে পারল। অবশ্য সাইরেনের শব্দ শুনে সাবধান হাওয়ার মতো তখন কেউ আর বাকি ছিল না। জাফি যখন লাল পাথরের চাঁইয়ের কাছে পৌঁছালো তখন আর সেখানে কিছুই অবশিষ্ট নেই।

ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, ইসকুল, ব্যাঙ্ক —কিচ্ছু আস্ত নেই। মনে হচ্ছে এক প্রলয় বয়ে গেছে পাথরের ওপর দিয়ে। প্রলয়ই তো। এই দুপেয়ে মানুষদের চেয়ে ভয়ংকর প্রলয় আর কী বা আছে!"


জাফির অ্যাডভেঞ্চার 
আহমেদ খান হীরক

প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৮০ টাকা

#সুপ্রকাশ






Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।