বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া। সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

আসছে দ্বিতীয় সংস্করণ
..................................

"আমাদের শহরে তখন আইসক্রিমের অতি বাড়-বাড়ন্ত ছিল। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছিল বেশ কয়েকটা আইসক্রিম কল। সারা বছর কলগুলো মাছবাজারে ব্যবহারের বরফ বানাতো, আর গরম পড়লেই আইসক্রিম। তখন সবই ছিল কাঠি আইসক্রিম, কাপের বাবুয়ানা তখনও তেমন চালু হয়নি। একটা সাধারণ বরফ-আইসক্রিমের দাম ছিল পাঁচ পয়সা, দুধ বা সাদা ফুসফুসে আইসক্রিম দশ পয়সা, গাঢ় মেরুণ রঙের চকলেট আইসক্রিম পনেরো পয়সা, সুপার কোয়ালিটি চকলেট আইসক্রিম বিশ পয়সা। আমার জ্ঞান হওয়ার ঠিক আগেই নাকি বরফ আইসক্রিমের দাম ছিল দুই থেকে তিন পয়সা। আমার পরীদিদি বলত, খুব খারাপ সময়ে নাকি আমার জন্ম। যা হোক, আমরা সেই পাঁচ পয়সার বরফ আইসক্রিম খেতাম মাঝে মাঝে। কোথা থেকে যে পয়সা আসত, তা বলতে পারব না। চিনির জোগান চিন্তামণি জোগাতেন কিনা জানি না, কিন্তু ছুটির দিনে আইসক্রিমওয়ালার হাঁক কানে এলে এবং বাবা বাড়িতে না থাকলে দিদিদের বইয়ের ফাঁকফোকড় থেকে দু-চারটে পয়সা, দশ পয়সা, তিন কোণা তিন পয়সা, দু পয়সা, এক পয়সা বের হতো।-- সেই রেজগিগুলো গেঁথে গেঁথে আইসক্রিম কেনা হতো।
এখানে আইসক্রিম খাওয়ার পশ্চাদপটটি বলে রাখা ভালোঃ ছোটোবেলা থেকেই মা-কে অসুস্থ দেখেছি। বহু সন্তানের মায়েরা যেমন ভগ্নস্বাস্থ্য হতেন, তেমন। মা লজেন্স আর আইসক্রিম খেতে খুব ভালোবাসতেন। প্রথমে লজেন্সের কথাটা বলে নিই। তখন লজেন্সের দাম চিল সামান্য। এক নয়া পয়সা থেকে পাঁচ পয়সার মধ্যে বাঘা বাঘা লজেন্স পাওয়া যেত। কাগজে মোড়ানো লজেন্সকে আমরা বড়োলোকের লজেন্স বলে জানতাম। কাঙালেরা যা করে, আমরা একটা-দুটো পয়সা পেলেই সস্তার লজেন্স খেতাম। আমার তো স্বপ্নই ছিল-- আমার এক ঘর ভর্তি একেবারে ঠাসাঠাসি লজেন্স থাকবে। আমি দরজাটা ফাঁক করে টুক করে একটা-দুটো লজেন্স বের করে নেবো-- নিজে খাব, মা যত খেতে চায়, সারাদিন মাকে লজেন্স দেব। বার বার দেখব লজেন্স পেয়ে মায়ের সেই হাসিটা!

আইসক্রিম, লজেন্স ভালোবাসলেও মা সে-কথা কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারতেন না। বাবা কখনও মায়ের হাতে পয়সা-কড়ি দেননি। গৃহিণী বা মেয়েদের তেমন কোনো অধিকার তিনি স্বীকার করতেন বলে মনে পড়ে না। দিমা মারা যাওয়ার পর তো আমাদের বারোদোলের তরমুজের ফালিটাও হাতছাড়া হয়ে গেছিল, মা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সেজন্য গরমকাল আসার ঢের আগে থেকে আমরা বোনেরা এক পয়সা, দু পয়সা করে জমাতাম। তা দিয়েই বাবার অনুপস্থিতিতে বছরে দুবার আইসক্রিম কেনা হতো। আমাদের রুগ্না মা তাঁর বিছানার বাইরে হয়তো আরও অনেক কিছু ভালোবাসতেন, কিন্তু তাঁর কথা শোনার কেউ ছিল না, সে-সব কথা আমাদেরও জানা হয়নি।

মাঝখানে কয়েকটা দশক চলে গিয়েছে। দিদিরা অনেকেই দুঃখে কষ্টে তাপিত-হৃদয়ে চলে গেছেন। আমাদের সেই সুন্দর বাড়িটাও নেই। দাদারা ইচ্ছে মতো বেচে দিয়ে চলে গেছেন যে যার মতো।
আমাদের বাড়ির রাস্তা ঘিরে গৌর মিষ্টান্নের সেই সিঙারার গন্ধ হয়তো এখনও আছে, নববরূপে। রাস্তার ফাস্ট ফুডের দোকানগুলো থেকে এখন আরও কত রকমের গন্ধ মিশছে বাতাসে। নটরাজ রেস্টুরেন্টও নেই। এখন হয়তো নটরাজের সেদিনের মেনুবোর্ডের খাবারের অনেকগুলোই কেনা যায়, কিন্তু সেদিনের বয়সটা আর নিষিদ্ধ খাবারের প্রতি রসনার অভ্যর্থনাটা আজ আর নেই।
সে-নিয়ে কোনো আফশোসও নেই-- শুধু আমাদের চির-দুঃখী পরীদিদিটা কষা কষা লাল লাল আলুর দম দিয়ে একটা মাত্র ঢাকাই পরোটা খাবার সাধ নিয়ে চিরকালের জন্য নিষ্ক্রান্ত হয়েছে।"

কাঙালের খাওয়া দাওয়া
স্বাতী দাস

বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া
সম্পাদনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদঃ শোভন সরকার
অলংকরণঃ অদ্বয় দত্ত

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।