বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় সুপ্রকাশ : ৪৯৯
.................................................................
"ঝুলতে থাকা লোকটাকে অঞ্চলের মশামাছিরাও চিনত, আর দূরান্তের যারা তাকে নামে চিনত না তারা অন্তত পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে সম্ভ্রমের চোখে দেখতে বাধ্য থাকবে কারণ তার মহিমা ছিল দূরগামী আর ছায়া দীর্ঘ। বীরেশ্বর সামন্ত নামটা এতদিনে ছোটো হয়ে সামন্তবাবু অথবা প্রধান স্যারে রূপান্তরিত হয়েছিল আর গ্রামের রুলিং পার্টি তাকে সম্মানসূচক বড়দা নামে অভিহিত করলেও পুরোনো দিনের মানুষদের কেউ তাকে ছোটোবাবু বলেও ডেকেছিল কারণ তার বাবা যোগেশ্বর সামন্তর গল্পগাছা ততদিনে দক্ষিণে কাকদ্বীপ আর উত্তরে কুলপি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। মানুষের সম্বোধন তত বেশি, যতদূর যায় তার মহিমা। যে মাঠে সে ঝুলছিল তাকে পেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে গেলে নদীর রাস্তা চোখে পড়ে যেখানে জেটির দিকে গড়িয়ে যাওয়া পথের দু'ধারে বাজার যারা ফুলেফলে পল্লবিত হয়েছে ক্রমবিস্তীর্ণ বীরেশ্বর সামন্তের প্রতাপে। এই বাজারের মালিক ছিল সে। ফুলুরি, বেগুনি, মিষ্টির দোকান, গামছা, জালের সুতো, নৌকোর পালের জিন, কাপড়ের গুমটি, ডাল-মশলার আড়ত, মনিহারি অথবা একটু এগোলে টোটো স্ট্যান্ড আর শনিমন্দির, এই সমগ্রটুকু এবং জেটির মাথায় পোর্ট কমিশনারের চকচকে সিম্বল নিয়ে, দোকানের সারির পেছনে খোলা মেঘের চিত্রপটে ডিম্বাকার ইটভাটার মাঝখানে চুল্লি ঘেঁষে পাকা গাঁথনির চিমনিকে সঙ্গে করে, যেখানে সার বেঁধে ইটের পাঁজা আর পাকা ইটের গাঁথনিতে শ্যাওলার ছোপ আর রোজ তাল তাল জমি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ঢুকে যায় চুল্লির ভেতর আর সাদা বালির ওপর কাঠের ফরমা ঠোকার একঘেয়ে শব্দ সারাদিন চলে, যাতে ফরমা ওলটালে তলতলে নরম ইট, আর চিমনির মুখ দিয়ে কয়লার ধোঁয়া। ইটভাটার পেছনে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে থমথমে পাঁচিলের ওধারে নির্মীয়মাণ রিভারসাইড প্রজেক্ট, সেখানে সারি সারি বাংলোর ছবিওয়ালা সাইনবোর্ড আর বিস্ফারিত চোখে সুন্দরীর দু'গালে হাত, কলকাতা থেকে মাত্র একঘণ্টা দূরে নদীর ধারে সমস্ত রকম আধুনিক সুবিধাযুক্ত ভিলা! মাত্র চব্বিশ লাখ থেকে শুরু!! সত্যি? তেমন সমস্ত কিছুকে নিজের শরীরে ধারণ করে যেন দৈবযোগেই এই লোকালয়ের জানুয়ারি ভরে উঠেছিল আকস্মিক আর্দ্রতায়, যেদিন বীরেশ্বর সামন্তকে আবিষ্কার করল ইটভাটার কুলিদের দল। থকথকে কালচে মেঘ নদীর ওপার থেকে গড়িয়ে এসেছিল। ঘোলাটে দিন বিষণ্ণ করেছিল স্যাঁতস্যাঁতে গঞ্জকে। এক নারকীয় নিস্তব্ধতার মুখে দাঁড়িয়ে মানুষজন মাথা নিচু করেছিল, তারা অকারণ ফিসফিসিয়ে কথা বলছিল, বলখেলার মাঠে দাঁড়িয়ে তারা উপভোগ করছিল বীরেশ্বর সামন্তর মাথার ওপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকা কাকেদের নিবিড় আলোচনা, আর চট ও পলিথিনে নিজেকে আবৃত করে গঞ্জের বাজার শীতঘুম লাগাল। কুকুরের দল কাছেপিঠে রুষ্ট হয়েছিল আর কাকেদের দল গা ঝাড়া দিয়ে নেমে আসতে চাইছিল মৃ তদেহের পরিসরে, তাদের অশুভ সংকেতের কোলাহলে ছিঁড়ে যাচ্ছিল যেখানে যতটুকু শোকের সম্ভার। পোকাদের দল ঘুমন্ত জেটির আশেপাশে ক্লান্তিহীন ভনভন করতে থাকল আর সন্তোষ নামের বাচ্চা ছেলেটা, যে সামন্তবাড়ির থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করে টোটো নামিয়েছিল জেটির মোড়ে, সে মিয়ানো চপের দোকানে গুটিশুটি মেরে হাঁটুর ভেতর মাথা গোঁজার আগে বলেছিল—দেবু বাগাল তাহলে কথা রাখল আর তারপর ঘুমিয়ে পড়ল বেঞ্চির ওপর বসেই, তখন দোকানি ভজা ঘোষ ফাঁকা টাউন ও অনুপস্থিত খদ্দের ভেবে বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কারণ আজ এদিকে কেউ বিশেষ আসবে না আর ইটভাটার কাজও বন্ধ থাকবে। সামন্তর মৃ তদেহ দেখার জন্য লোকে ভিড় জমাবে বটগাছ ঘিরে যতক্ষণ না পুলিশ এসে সবাইকে হটিয়ে দেয়, তারপর তারা মাঠে বসে নিজেদের ভেতর জটলায় গুজগুজ করবে আর সবশেষে ঘরে ঢুকে যাবার পর সন্ধের কুয়াশা, টিপটিপে বৃষ্টি আর কম দামি বালবের ইতস্তত আলেয়াদল যথেষ্ট হবে না টাউনকে জাগিয়ে রাখতে, কারণ জেটি থেকে বয়ে আসা হাহাকার বাতাস উটকো স্মৃতির মতো ছত্রভঙ্গ করবে ব্যস্ততা ও কারুকাজ, কারণ বীরেশ্বর সামন্ত অবশেষে খু ন হয়েছে।"
.
.
.
বীরেশ্বর সামন্তর হ ত্যা রহস্য
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment