প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।
'অজস্র মহাবৃক্ষবেষ্টিত এই মধ্যম-পরিসর বনস্থলীর ঈষৎ রুক্ষ ভুমিতে তাঁদের শকটটির অগ্রভাগ একটি প্রকৃতিসৃষ্ট মৃত্তিকানির্মিত বেদীর আশ্রয় পাওয়ায় এখনকার মতো অর্ধ-প্রণত। এই দীর্ঘ যাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সাধারণ উদক বা 'সদুজল'। সেই উদকের পিপাবাহী অন্য শকটটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তিনসারি বৃক্ষ পেরিয়ে পাশ্ববর্তী বনস্থলীতে। সেটি এই বনস্থলীটির তুলনায় অপেক্ষাকৃত সুপরিসর; সেখানেই আজকের মতো অধিকাংশ 'দুসকুটি' বা মণ্ডপাদি স্থাপনা করা হবে। এবং এই ক্ষুদ্রাকার বনস্থলীতে নিশাচর্যাকারীদের পালাক্রমিক আশ্রয়ের জন্য একটিমাত্র মণ্ডপ রচনা করলেই চলবে।
জতুরসে রঞ্জিত স্থূল বস্ত্রসহ দুসসকুটি রচনার সামগ্রীগুলি উদকবাহী শকটের পশ্চাদ্ভাগে বিন্যস্ত থাকে। মহোদাচার্য মহাকনককাঞ্চন সম্প্রতি অশীতিবর্ষ বয়স অতিক্রম করেছেন, তিনি শরীরচর্চালব্ধ অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও বয়ঃক্রমিক প্রাচীনতার কারণে ইদানিং তাঁর নানাবিধ কায়িক সমস্যা দেখা দিয়েছে। বনজ ইন্ধনের ধূম্ররাশি তাঁকে পীড়িত করে বলে তাঁর মূল অবস্থানের বনস্থলীটির কিয়ৎ দূরত্বে এই ক্ষুদ্রাকার বনস্থলীতে রন্ধনের আয়োজন করতে হয়েছে।
শকটদুটি সাধারণ গো-শকট নয়—দুটি শকটই বিশেষভাবে নির্মিত চারচক্রবিশিষ্ট। পশ্চাদ্ভাগের চক্রদুটির ওপরেও বংশনির্মিত পাটাতনের বিস্তার। বয়সের কারণে আচার্য মহাকনককাঞ্চন একাদিক্রমে বেশিক্ষণ পদব্রজে চলতে পারেন না। ক্লান্ত হলে তিনি এই অংশে উপবেশন করেন। এই পদ্ধতি ভিক্ষু স্থিতধীমান-কর্তৃক প্রবর্তিত! শকটদুটিকে ভিক্ষুদল পালাক্রমে টেনে আনছেন সেই সুদূর পিঙ্গলগিরির উত্তরাংশে শাল-গজার, পিয়ালের বৃক্ষশোভিত অরণ্যের শতাব্দী-প্রাচীন ছায়ায় রক্ষিত সারবানবিহার থেকে। পথে কত গাম, গামগেহ, নাম-না-জানা অথচ নিজ পরিচয়ের একান্ত অস্তিত্বে গরীয়ান ক্ষুদ্র ও মধ্যম জনপদ পেরিয়ে এসেছেন তাঁরা।
বক্ষ্যমাণ বনস্থলীর শকটটি দেখতে সাধারণ চতুঃচক্রবিশিষ্ট অশ্বকর্ষী শকটেরই অনুরূপ, কিন্তু অগ্র-পশ্চাতে অস্বাভাবিক বিস্তৃত পাটাতনযুক্ত। সেই কারণে অগ্রে এক-হস্ত বা অষ্টাদশ কর-পরিমাণ অংশ অনধিকৃত ও শূন্য। গো বা অশ্ব-শকট হলে এই স্থানটি দ্বিগুণ পরিমাণ হতেই হতো, অন্যূনপক্ষে শকটের চালক ও তার সহায়ক—এই দুজনের উপবেশন-স্থান ও অত্যধিক সময় একাদিক্রমে উপবেশনজনিত শরীরী অস্বস্তি ও অবসাদ দূর করার মতো চাঞ্চল্যপ্রকাশের পরিসর থাকতেই হতো। কিন্তু মনুষ্য-চালিত এই শকটের অগ্রের ঐ স্থানটুকু ব্যতিরেকে পশ্চাদ্দেশ অবধি অবশিষ্ট সর্বাংশই বংশনির্মিত ছাউনির ওপর 'থুল' বস্ত্রের আবরণে আচ্ছাদিত।
অন্যান্য শকটের মতোই এই শকটটিরও অগ্রের ডান ও বাম—অর্থাৎ শকটের মঞ্চ ছাড়িয়ে দুদিকে দুই হস্ত-পরিমাণ পরিবর্ধিত এবং কাষ্ঠ ও সাং-এর পাশির দুটি প্রান্ত দৃশ্যত তৈল-পক্ক বংশের মতো মধ্যম গড়নের বংশদণ্ড দ্বারা দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। দৃঢ়তার প্রয়োজনে দু-দিকেই পার্শ্বের কাষ্ঠ ও সাং-এর সঙ্গে তা লৌহ কীলক দ্বারা সংগ্রথিত। পশুচালিত শকটে এই দণ্ডের দু-পাশে দুটি পশুকে বেঁধে দেওয়া হয়। এই শকটটি মনুষ্য-চালিত বলেই এই বংশখণ্ডটিকে ধারণ করেই শকটটিকে টেনে আনা যায়, কিন্তু সামগ্রীর ভার অত্যধিক হলে মঞ্চ ও বংশখণ্ডের মাঝখানে ঢুকে কটিদেশের সম্মুখভাগে বংশখণ্ডটি লাগিয়ে শকটটিকে টানতে হয়।
এই যাত্রায় দুটি শকট ব্যবহৃত হচ্ছে। শকট দুটিকে এভাবেই দীর্ঘ পথ পালাক্রমে ভিক্ষু দলকে টেনে আনতে হচ্ছে বলে দলের প্রায় সকলেই কম-বেশি ক্লান্ত। কারও কারও ক্লান্তির থেকে বিরক্তি বেশি। এই দলের মধ্যে বিরক্তি সবচেয়ে বেশি সুপুণ্যকেরই। আহার-বিহার-পোশাক-পরিচ্ছদ গ্রহণ ও ধারণ, রাত্রিকালীন বিশ্রামের ব্যবস্থা—এই দীর্ঘ যাত্রা, যাত্রাপথের যাবতীয় বিপৎপত্তি, একজন ভিক্ষুর নিত্যকর্মাদি সম্পাদন, অনুশাসন প্রতিপালন—সর্ব-বিষয়েই তাঁর অন্তরে নিজস্ব এক জিজ্ঞাসিত-অসন্তুষ্টি রয়েছে।'
..........................................................
প্রতিযাত্রা
দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিতব্য
Comments
Post a Comment