বাঘাচাঁদের কথাকাব্য।। অনিল ঘোষ।। সুপ্রকাশ।।
"এ সেই কালের কথা, যখন বাদাবন হাসিল করতে এসেছিল মানুষ। কাঁহা কাঁহা মুলুক থেকে এসেছিল তারা। হুই রাজমহল পাহাড় থেকে, মেদিনীমল্ল, ধলভূম, রাঢ়দেশ থেকে। আর নদী-নালা-খাল-বিলের মানুষ আসছে তো আসছেই। কেন আসছে? দেশে তখন ঘোর আকাল। হা-অন্ন কোথা অন্ন রব চারিদিকে। একমুঠো অন্নের খোঁজে মানুষ ছুটছে দিকবিদিক। কেউ যায় দক্ষিণে তো কেউ পুবে, কেউ উত্তরে তো কেউ পশ্চিমে। এইভাবে ছুটতে ছুটতে তাদের একটা দল পৌঁছল এই বাদার দেশে। তাদের কী দশা গো! হাড় জিরজিরে চেহারা। না খেয়ে খেয়ে পেট-পিঠ সমান হয়ে গেছে। হাঁটতে গেলে টাল খায়। হাঁস-ফাঁস শ্বাস ছাড়ে ঘনঘন। তবু স্বপ্ন তাদের চোখে। বুকে আশা আর কানে ভরসার মন্ত্র— জঙ্গল হাসিল করো। জঙ্গল হাসিল হলে জমিন পাবে, জমিন পেলে চাষ হবে, চাষ হলে ফসল ফলবে, ফসল ফললে ভাত পাবে। পেট ভরা ভাত। আর ভাত পেলে সুখ পাবে। বাঁচার সুখ। বাঁচে কীসে? খেয়ে-পরে, হেসে-খেলে, বে- শাদি করে, ছানাপোনার মুখ দেখে, সংসার ধরমের মধ্যে। এসব সুখের কথা। সুখ বাবা এমন, ওতে নেশা ধরে। হাড়িয়া-পচুই-এর নেশা তখন কোথায় লাগে! এ বাবা তার থেকেও চটকদার নেশা। আর সেই নেশার হাত-হাতিয়ার সব তৈরি। বাদায় চলো, জঙ্গল হাসিল করো, কুড়াল মারো, কোদাল চালাও। চলো চলো ভাইসব— এই আওয়াজে মুখরিত চারদিক।
কিন্তু বাবা, সেই বাদাবন কি আজকের এই রিকেটি রুগির মতো পাকাটি মার্কা চেহারা নাকি! সে বন ছিল যেমন বিশাল, তেমনি ঘন। দিনের বেলায় দিনতারা (সূর্য) ঢোকার পথ পেত না। আঁধারে আঁধারে ছয়লাপ। গাছগুলো হাত-পা মেলে দাঁড়িয়ে। মাথা হুই আকাশে। নোনা মাটিতে মুখ তুলে আছে মোটা মোটা হুলের মতো শুলো (শ্বাসমূল)। হাঁ করে শ্বাস নেয়। আর আছে নোনা গাঙ। কী বিশাল তার চেহারা! ঘোলা ঘোলা জলের ঢেউ উপচে পড়ে। ছপাৎ ছপাৎ শব্দে পাড়ের মাটি খায়। তার সঙ্গে লড়াই গাছেদের। গাঙের নোনাজলের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচে তারা। তাই এক একটা গাছে শয়ে শয়ে শুলো মুখ তুলে, দাঁতে দাঁত চেপে মাটি কামড়ে ধরে। ওগুলোই গাছের টিকে থাকার লড়াই। ভাবখানা এমন— হেই গাঙ, কত খাবি খা, আমি তোর বুকে শুলো চালাই, জলের বুকে জেগে থাকি। পারবি না আমায় মারতে। নোনা গাঙে মাছ খলবলায়। কত নামের মাছ। আড় ট্যাংরা, ভোলা ভেটকি, পাঙাস, গুড়জাউলি আরও কত কী। কত তাদের আকার, কত ধরন। ছোটো বড়ো। জলে খেলা করে শুশুক। জল আর নোনা চরে বাস কুমির-কামটের। একবার বেখেয়াল হয়েছ কী, ভুউস শব্দ হবে শুধু। টিকিরও দেখা মিলবে না। এই বনে পা রাখবে কে! কার আছে হিম্মত? বুকের পাটা থাকলে জল-জঙ্গলের দেশে চলো। কথাটা বলা সোজা, করা কঠিন। বাপসকল, জানোই তো, বাদাবনে শুধু গাছ নেই, মাছ নেই, কুমির-কামট নেই। আছে সাপখোপ, বিষাক্ত পোকামাকড়। আর আছেন তিনি। তিনি কে?—
তেনার নাম বড়ো মিয়া সোঁদরবনের বাপ
দাঁত আছে নখ আছে পিলে ফাটানো ডাক।
তিনি হলেন বনের রাজা বনের সীমা রাজ্য
তফাত যাও তফাত যাও নইলে হবে খাদ্য।
তোমগা কথায় যিনি বাঘ, ব্যাঘ্র, শের, শার্দুল—আঙগা ভাষায় তিনি হলেন বড়োমিয়া, দখিনরায়। কত নাম তেনার। কত নামে তিনি খাতির পান— ভালোবেসে, ভয়ে ভক্তিতে। চোখে তো দ্যাখোনি। দেখলে ভাব ভালোবাসা সব পিছন দিয়ে আমবাত হয়ে বেরিয়ে যেত। বুঝতে কী জিনিস তিনি। সহজে তার দেখা পাওয়া যায় না। সামনেও আসেন না। তেনার চলাফেরা, কাজকর্ম সব পিছনে পিছনে, আড়ালে-আবডালে। নিঃশব্দে ওঁত পেতে থাকেন। সুযোগ বুঝে হালুম। একেবারে ঘাড় মটকে লাশ সমেত হাওয়া। কথাটা বলতে যতটা সময় লাগল, তার আগেই তেনার কাজ সারা হয়ে যাবে। বাদাবনে এই জিনিস থাকার মানে বোঝো! একটা রক্তচক্ষু যেন অদৃশ্য সীমারেখা টেনে দেয়। ওই সীমা টপকেছ কী, চোখের পলকে হুউস। হাড়গোড়েরও খোঁজ মিলবে না। তেনারে নিয়ে বাদাবনে কত কিসসা কাহিনি। সেসব শুনতে শুনতে হাড়ে কাঁপন ধরে। গা শিরশিরানো সেইসব কথা।
তা বাবা, জঙ্গল হাসিল করবে বলে যে সব হাড়-হাভাতে মানুষজন হাত-হাতিয়ার নিয়ে তৈরি হয়েছিল, পা বাড়িয়েছিল জঙ্গলে ঢুকবে বলে- তারাও এইসব কথা-কাহিনি শোনে। শুনতে শুনতে ভয়ে তাদের হাত-পা গুটিয়ে পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এগোবে কী, এক পা এগোলে দশ পা পিছোতে হয়। ভয়টা প্রাণের। এ কথা কে না জানে, প্রাণের মায়া বড়ো মায়া। ও যে অমূল্যধন। ওখানে পেট বাবাজিও হার মানে। ওরা এগোতে পারছে না ভয়ে, আবার পিছোতেও পারছে না আশঙ্কায়। পিছোবে তো কোথায়! আবার তো সেই আকালের খপ্পরে পড়া। হায় হায়, জমিন-ধান-সুখ— সব বুঝি মিছা হয়ে গেল! রয়ে গেল বুঝি স্বপ্নে!
কপাল চাপড়ায় ওরা। বুকের কান্না চোখের জল হয়ে নামে হু হু ধারায়। এ যে তীরে এসে তরী ডোবার জোগাড়—
ঘর গেল জমিন গেল আর গেল সুখ
পাড়ি দেলাম কত পথ গেল নাকো দুখ।
বড়োমিয়া মুখপোড়া ভিটে হল চাঁটি
হায় হায় হল বুঝি পোড়া দেহ মাটি।
এই যখন অবস্থা, সেই সময় কোথা থেকে দৈববাণীর মতো শোনা গেল বাজখাঁই গলার আওয়াজ। সবার মাঝে লাফ দিয়ে পড়ল এক পুরুষ—
এইখানেতে ঢ্যাঙা মানুষ আগিয়া আসিল
কুড়াল তুলে একাই সে হাঁকিয়া বলিল—
আগে মরণ পিছে মরণ তবে কী করবা
মরতি যদি হয় গো বাঘের নেগেই মরবা।
এই হল আঙগা বাঘাচাঁদ। তারে দেখতে কেমন! ইয়া দশাসই চেহারা। কালো পাথরপানা গতর। মাঠপানা বুকের ছাতি। হুই তালগাছের মতো ঢ্যাঙা। বড়ো বড়ো চোখ আর কুচকুচে কালো চুল। গলার আওয়াজ যেন ঢাকের মতো। গুড়গুড় করে বেজে চলে একটানা। তবে সে সত্যিকারের কে, কী তার পরিচয়— এসব জিগালে বলে—
আঁধার গাঁয়ে বাস ছিল কোনও এক কালে
নেচেকুঁদে বেলা যেত ধানমাঠের আলে।
বাপ মাও ছিল সেথা আর ভাইবোন
মোর নাম কী ছিল নাহিক শরণ।
নাম যখন স্মরণে নেই, তখন আর কী, ওই বাঘাচাঁদই সই।"
..............................................
বাঘাচাঁদের কথাকাব্য
অনিল ঘোষ
.................................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য। আসছে কলকাতা বইমেলায়।
Comments
Post a Comment