স্মৃতিভারে পড়ে আছি।। সন্ধ্যা রায় সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।

"তোমার মনে আছে কবে তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল?

১৯৫৯ সাল। তেসরা জানুয়ারি। ২রা জানুয়ারি আমাদের নতুন বছরের অর্থাৎ ক্লাশ নাইনের ক্লাশ শুরু হয়েছিল। কিন্তু আমি সেদিন অনুপস্থিত ছিলাম। আমার ছোড়দি, অঞ্জলি, যে আমারই সহপাঠী, স্কুলে গিয়েছিল। স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসেই আমাকে স্কুলের খবর জানিয়েছিল—আমাগো ক্লাশে একটা ছ্যামড়া নতুন ভর্তি হইছে—খুউব ফড্র ফড্র করে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আর? আর কী করে? ঠিক আছে। কাইল তো ইস্কুলে যামু, তহন দেখমু। এরকমই মনে মনে ভেবে নিলাম।

পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখলাম আরও তিন চারজন ছাত্র আমাদের স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে।

আমরা মাস্টার মশাইদের সঙ্গেই ক্লাশে ঢুকতাম। আবার ক্লাশ শেষ হলে মাস্টার মশাইদের সঙ্গেই ক্লাশ থেকে বেরিয়ে আসতাম। টিচার্স রুমের একটা সাইডে আমাদের বসার জন্য বেঞ্চ থাকত।

আমাদের ক্লাশ নিতেন অশ্বিনী বাবু। উনি ক্লাশে ঢুকতেন কথা বলতে বলতে। উনি যা বলবেন সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করে খাতা নিয়ে দিতে গেছি। অমনি তুমি আমাকে প্রায় টপকে স্যারের কাছে খাতা দিতে গেছ। স্যার কিন্তু হাত বাড়িয়ে আমার খাতাটাই আগে নিয়েছিলেন। তোমার কী রাগ সেদিন! রেগে মেগে বলেই ফেলেছিলে— 'এরকম পক্ষপাতিত্ব মানবো না'। স্যার তোমাকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু সেই থেকেই শুরু হয়েছিল তোমার সঙ্গে রেষারেষি। অঙ্ক ক্লাশে সবসময়ই আমি আগে অঙ্ক কষে ফেলতাম। তোমার রাগ ছিল সেইজন্যও।

তখন আমরা সদ্য কৈশোরে। তুমি বলেছিলে তুমি নাকি প্রাইমারিতে পড়াকালীন এক বছরের সিনিয়র ছিলে। এক বছর তোমার স্কুল করা হয়নি। এভাবেই আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল। স্কুলে পড়াকালীন প্রায় সবদিনই তোমার সঙ্গে ঝগড়া হতো। তোমার ধারণা ছিল আমি মেয়ে বলে মাস্টারমশাইরা আমাকে বেশি নম্বর দেয়। আমাদের ক্লাশে আরও অনেক ছাত্র ছিল যাদের সঙ্গে আমি সেভেন এইট থেকেই পড়ছি। তারা কিন্তু কেউই এরকম ভাবত এমন মনে হয়নি। আমি সংস্কৃত পড়তে ভালবাসতাম না। তাই সংস্কৃতে কোনাদিনই ভাল নম্বর পেতাম না। কোনোমতে টেনে মেনে ছয়ের ঘরে। তুমি সব পরীক্ষাতেই আটের ঘরে নয়ের ঘরে নম্বর পেতে। নাইন থেকে টেনে ওঠার সময়েও আমি ফার্স্ট আর তুমি সেকেন্ড। তাই আমাদের ঝগড়াটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।

এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই সংকটজনক। আটান্নর 'পিসফুল রেভোলিউশন' বা রক্তপাতহীন বিপ্লব যা আইয়ুব খাঁয়ের নেতৃত্বে সামরিক শাসনের সূচনা করেছিল— তার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আমরা যখন ক্লাশ এইটে পড়ি তখনই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। রাজনীতি বোঝার বয়স বা পারিপার্শ্বিকতা কোনোটাই ছিল না। পরবর্তী কালে অর্থাৎ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি তখনকার পরিস্থিতি অনেক সহজবোধ্য হয়েছিল। তাই সেই সময়কার পরিস্থিতি পরবর্তীকালের অনুভবের সাহায্যেই তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টায় তুমি এদেশে।

একদিন বাংলা ক্লাশের পর তুমি হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে—দুর্ভিক্ষ শব্দের ব্যাস বাক্য সহ সমাসের নাম বলতো? আমি হেসে বলে উঠলাম—ভিক্ষার অভাব—দুর্ভিক্ষ—অব্যয়ী ভাব সমাস। তুমি বললে—ঠিকই। ভিক্ষাও মিল ছিল না। মানুষের কষ্টদুঃখের শেষ ছিল না।

আইউবশাহী আমলের আগে আমাদের দেশে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল মারাত্মক। পরবর্তীকালে বুঝেছি যে, আমাদের দেশের প্রান্তিক চাষিরা ফসল ওঠার দেড় দুমাস আগে থেকেই অনাহারে বা অর্ধাহারে কাটাতে বাধ্য হয়। দেশের সরকার সেসব স্বীকার করেনা। পাকিস্তান শিশু রাষ্ট্র। তাই তাকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোতে হচ্ছে। আর এই শিশু রাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে সরকার তার দায় এড়াত। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, যেমন আমাদের দেশের স্বাভাবিক চিত্র, দুর্ভিক্ষকেই দেশের সাধারণ মানুষেরা, যেন স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়—সরকারের আবদারটা তেমনই ছিল। এমন সব ভাবনা আমাদের সহপাঠীদের মনে ঠিক এমনভাবে না হলেও, হতো। কিন্তু গুছিয়ে ভাবতে পারতাম না।"
..................................
স্মৃতিভারে পড়ে আছি
সন্ধ্যা রায় সেনগুপ্ত
..................................
পুনর্বিন্যাস, সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়।


Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।