আমার রবীন্দ্রনাথ, আমাদের। আলাপ বিলাপ। স্বপ্নময় চক্রবর্তী

 বাগবাজারের খালধারে ছিল আমাদের বাসাবাড়ি। আমরা পাঁচ ঘর ভাড়াটে ছিলাম। একতলায় ছিল একটিমাত্র কলঘর। সিঁড়ির কোনায় ঘুঁটের ঝুড়ি রাখা দিয়ে শিখার মা-র সঙ্গে নিয়ে আমার মায়ের ঝগড়া হতো মনে পড়ে।

একদিন আমার বোন 'আমার সোনার হরিণ চাই' গান গাইছিল। ও যেমন পারত আর কী ! আর শিখা চেঁচামেচি শুরু করে দিল। 'লজ্জা করে না, আমাদের গান গাইছিস, আমাদের গান একদম গাইবি না।'

শিখার বাবা ছিলেন গানের মাস্টার। শাড়ি-পরা বড় বড় মেয়েরা সব গান শিখতে আসত। আমার মায়ের একটা জার্মান রিডের হারমোনিয়াম ছিল। বাবা টিউশানি সেরে যেদিন ফিরতে দেরি করতেন, মা হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। একদিন মা 'আমার সোনার হরিণ চাই' গাইছিলেন। আমি আঙুলটা ঠোঁটের সামনে ধরে বলেছিলাম, 'চুপ, চুপ, এটা গেও না এটা গেও না, এটা শিখাদের'। মা দ্রুত ঘাড় কাত করে বলেছিলেন, 'ইঃ, আহ্লাদ ! ওদের গান ? রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথ সবার।'

তখন শুক্রবার শুক্রবার রেডিও-নাটক শোনার চল ছিল। একদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম 'ডাকঘর' হবে। আমাদের রেডিও ছিল না, শিখাদের ছিল। শিখাদের ঘরে এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে বউ-ঝিরা কোলে করে শুক্রবার আটটা বাজতে পাঁচের আগেই হাজির হয়ে যেত। শিখাদের ঘরের পিছনের বারান্দায় অন্ধকার সাপটে জানলার ধারে বসেছিলাম আমি আর মা। 'ডাকঘর' শুনলাম। মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছিলেন। মা আমারও চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিলেন। স্নেহ-আঁচলে। আর এরপর থেকেই আমার জ্বর হলে সুধা এসে ঠিক আমার শিয়রে বসে থাকত। সুধার সঙ্গে কথা বলতাম আমি।
এমনি করে রবীন্দ্রনাথ না-জানিয়েই চুপি চুপি আমাদের জীবনের সঙ্গে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে, স্বপ্নের মধ্যে মিশতে থাকলেন।

আমি যখন ক্লাস ফোরের বৃত্তি দেব, আমার মেজোকাকা তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দেবেন। কাকা অনেক রাত অবধি পড়ছেন। আমিও জেগে আছি। তখন যুদ্ধ লেগেছে। রাস্তার আলোগুলোর চোখে ঠুলি পরানো। ব্ল্যাক আউট হলো। কাকামণি ওঁর মোটা বইয়ের তলা থেকে বার করলেন একটা ছবি না-ছাপা বই। হেরিকেনের আলোয় কাকামণি বললেন, 'এখন লেখাপড়া থাক, এটা শোন। ক্ষুধিত পাষাণ।' অনেক রাত অবধি পড়লেন। এরপর সাইরেন বেজেছে কলকাতায় অনেকবার। সাইরেনের শব্দের মধ্যে আমি শুনতে পেতাম মেহের আলির চিৎকার। 'তফাৎ যাও... তফাৎ যাও... সব ঝুট হ্যায়।'
আমার মেজোকাকা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করলেন। বড় চাকরি হলো। ঘরেতে বেতার এল গুনগুনিয়ে। এইচ এম ভি ফিয়েস্তা এল, পুজোয় ভালো জামা, রবিবার মাংস। মেজোকাকা একদিন কিনে আনলেন পুরো রবীন্দ্ররচনাবলী। গায়ে অশোকস্তম্ভের ছাপ। মায়ের মাথা থেকে সেদিন বারবার ঘোমটা খসে যাচ্ছিল।
আর মেজোকাকা, আমার কাকামণি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর এক বছরেরও কম সময় পৃথিবীতে ছিলেন। সতেরো দিন শয্যাশায়ী হয়ে ভুল চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন। কাকামণি মৃত্যুকে টের পেয়েছিলেন। নইলে কেনই বা বলবেন, 'যদি মরে যাই, অনেক ফুল দিস। শ্রাদ্ধের দিন রবীন্দ্রসংগীত চালাস !'
দাদু তখনও বেঁচে। শ্রাদ্ধে কীর্তন এসেছিল। মা শুধু ছাদের সিঁড়ির কোণায় একা একা গেয়েছিলেন, 'শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে।'

এসব গানের মানে বোঝার বয়স হয়নি তখনও আমার। এখনও সব গানের মানে ঠিকমতো বুঝি না। অর্থ পালটে যায়।নতুন মানে নিয়ে গানগুলো আসে। কিন্তু মা যখন একা চুপিচুপি গানটা গাইছিলেন মায়ের চোখ থেকে জল পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা-- গাল বেয়ে। বুঝেছিলাম, দুঃখ শব্দটার মাঝখানের বিসর্গটা যেন দু-ফোঁটা চোখের জল।

আমার মাকে সব সামলাতে হতো। দাদু, ঠাকুরমা এবং আমার বাবা সবাই আমার মাকে বকাবকি করতেন। আমি বুঝতাম মা কষ্ট পাচ্ছেন, বুঝতাম মায়ের হয়ে কথা বলার মতো কেউ নেই। মা কোনো প্রতিবাদ করতে পারতেন না। মায়ের কষ্টপ্রকাশ করারও কোনো উপায় ছিল না। বাড়ির পাশে ছিল একটা বটগাছ। সেই বটগাছের কিছু শাখাপ্রশাখা ছাদের ওপর দুলত। মা বটগাছের কাছে গিয়ে একা একা কথা বলতেন। বোধহয় নিজের কষ্টের কথা। একদিন শুনি গাছটার কাছে মা গান গাইছেন একা। গানের মধ্যে শুনেছিলাম 'আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন'। 'দুখের প্রদীপ' শব্দটাও শুনেছিলাম। অনেক পরে জেনেছিলাম গানটার প্রথম লাইন 'আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন...।' কিন্তু সেই শৈশবে 'দুখের প্রদীপ' শব্দটা মর্মে গেঁথে গিয়েছিল। সন্ধ্যেবেলার প্রদীপটাকে মনে হতো 'ব্যথার প্রদীপ'।
বাবার পকেটে ভাঙা চকের টুকরো থাকতো। স্কুলের মাস্টারমশাই ছিলেন কিনা। সেই টুকরো খড়ি দিয়ে খড়খড়ে কালো বারান্দার মেঝেতে আমি কিছু লিখতাম। আমি তখন সদ্য সাক্ষর। কী লিখতাম মনে নেই, অক্ষর সাজিয়ে বাক্য তৈরী করতাম নিশ্চয়ই, তার মধ্যে 'দুঃখ', 'ব্যথা', 'ব্যথার প্রদীপ'--- এইসব থাকতো। প্রতিবাদও থাকতো হয়তো, নইলে কেন মা তাড়াতাড়ি জল-ন্যাকড়া দিয়ে আমার ওইসব বাক্যবন্ধ মুছে দিতেন। বলতেন, 'এসব লিখতে হয় না, কেউ দেখলে কী ভাববে ?' গায়ে হাত বুলোতেন। সান্ত্বনা পেতেন--- মায়ের দুঃখ আমি বুঝতে পারছি জেনে।
আমি যখন আমার মাকে হারালাম, মায়ের বয়স তখন আটচল্লিশ। আমি একটা গীতবিতান কিনে দিয়েছিলাম মাকে। ওই বইটা এখনও রয়েছে আমার সঙ্গী হয়ে। আমি গান গাইতে পারি না। মায়ের রোগশয্যায় রবীন্দ্রসংগীত শোনাতে পারিনি। টেপ রেকর্ডার ছিল না তখনও। রেডিওতে সাতটা চল্লিশে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ম করে চালাতাম।

'আমার রবীন্দ্রনাথ, আমাদের' থেকে।
আলাপ বিলাপ
স্বপ্নময় চক্রবর্তী

#সুপ্রকাশ


অনলাইন অর্ডার লিঙ্কঃ https://thinkerslane.com/?product=alap-bilap

বাংলাদেশে বইটি পেতে সুপ্রকাশের নাম করে নোকতা(বুবুক), তক্ষশিলা বা বাতিঘরে সুপ্রকাশে নাম করে অর্ডার দিতে পারেন।


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।