বাঙালির অশ্লীলতাবোধ। আলাপ বিলাপ। স্বপ্নময় চক্রবর্তী

 বাঙালি বা ভারতীয় পুরুষের চোখে 'পা' মোটেই 'সেক্সি' নয়। 'হাত-টাত'-ও নয়। গত শতাব্দীর খ্রিস্টানদের চােখে উন্মুক্ত 'হাত' বা 'পা' অশালীন ছিল। ইসলাম ধর্মের চোখে নারীদেহের সবই ঢাকা রাখা উচিত। ক্যানিং অঞ্চলে 'উরষ' উৎসবে একজন ইমাম বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমার বেশ মনে আছে, আমি রিপ্লে দেবার চেষ্টা করছি--

"মেয়েছেলেদের জন্যি আল্লাহ পরদার বিধান দেছেন। অনেক ভেবেচিন্তে এই বিধান। যদি বল, ক্যানো ? তাহলে বলি, তোমরা ক্যাঁটাল দেখিছ তো, ক্যাঁটাল ? বাইরে কাঁটা লাগানো ছাল। ছালটা খুলি ফেল্লিই রসে ভরা টসটসে ক্যাঁটালে কোয়া। য্যতখন ছালটা লাগানো থাকে, মাচি আসে না। ঝ্যাক্ষুনি ছালটা খুলি ফেললে, ত্যাক্ষুনি মাছি এসি ভিড় করতে থাকে। ক্যাঁটালের মধুর লোভে। পরদা হলো গে সেই ক্যাঁটা বসানো ক্যাঁটালের ছাল। মেয়েছেলের শরীর হলো ক্যাঁটালের কোয়া।"

হিন্দু মহিলাদের অবশ্য বোরখার পরিবর্তে ঘোমটার বিধান, অথচ বিয়ের সময় মেয়ে দেখতে গেলে পুরুষের সামনেই মেয়েদের শাড়ি ওঠাতে হতো হাঁটুর ওপর। পায়ের গোছ দেখা হতো। পিছন ফিরতে হতো। নিশ্চয়ই নিতম্বের গড়ন দেখা হতো। অর্থাৎ একটা ভোগ্যসামগ্রী যাচাই করা হচ্ছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না। এবং সামাজিকভাবে ব্যাপারটা মান্য ছিল।

কিন্তু গত শতাব্দীতে একসঙ্গে বসে খেউড় দেখার চল ছিল। মেয়েরা হয়তো একসঙ্গে বসে বা আলাদাভাবে দেখতেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বোধহয় এ ব্যাপারে অ্যাডভান্সড ছিলেন। শারদীয় পূজার সময় নবমী-কীর্তন উপলক্ষে নবমী পূজার দিন মহিষ বলিদানের পর কাদা খেউড়ের সময় স্বয়ং মহারাজ, যুবরাজ আর রাজকুমারীদের এক-একটি করে সকার বকারের খেউড় রচনা করে গাইতে হইত।
ব্যঞ্জনা প্রধান গানও থাকত--
ফুলের দাম পাই পয়সা
পেয়ারা দশ পাই
বিল্ব ফল এক তঙ্কা
লাউয়ের দাম নাই

বোঝাই যাচ্ছে স্তনের আকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই দাম বাড়ছে বা কমছে।
............................................................................................
বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। এতে করে নিবন্ধটি আরও মশলাদার হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে বেশি কচলানো আমাদের মধ্যবিত্ত রুচিতে বাধে। এই রুচিবোধ সবটাই কি ব্রিটিশ রুচিবোধ প্রভাবিত ? জয়গোপাল তর্কালঙ্কার নামে সংস্কৃত কলেজের যে পণ্ডিত ১৮২০ সাল নাগাদ কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত অশ্লীলতা মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তা কি ব্রিটিশ রুচির প্রভাবে ? অথচ ভারতচন্দ্র সেই সময়ে খুবই জনপ্রিয়। খেউড় চলছে, সঙ চলছে। এইসব লোকপরম্পরা থেকে মুক্ত করতে চাইছেন। অথচ কালিদাস অচ্ছুৎ নয়, এমনকি বাড়ির মেয়েরাও গীতগোবিন্দ থেকে রতিসুখসারে গান করলে বাহবা দিচ্ছেন, সেটা কি সংস্কৃত ভাষা বলে ? এদিকে একটি বারো বছরের বালিকা স্বামীর লিঙ্গপ্রহার সহ্য করতে না পেরে মারা যাবার পর বিদ্যাসাগর সহবাস সম্মতি আইন চেয়েছিলেন বলে কলকাতায় একটি বিশাল প্রতিবাদ সভা হয়। ওই সভাটি কি অশ্লীল ছিল না ?

'বাঙালির অশ্লীলতাবোধ' থেকে।
আলাপ বিলাপ
স্বপ্নময় চক্রবর্তী

#সুপ্রকাশ


অনলাইন অর্ডার লিঙ্কঃ https://thinkerslane.com/?product=alap-bilap

বাংলাদেশে বইটি পেতে সুপ্রকাশের নাম করে নোকতা(বুবুক), তক্ষশিলা বা বাতিঘরে সুপ্রকাশে নাম করে অর্ডার দিতে পারেন।


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।