ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। কল্লোল লাহিড়ী
"ইন্দুবালা কুরনিতে কচু আর নারকেল কোরে্ন। সেই কচু আর নারকেল সরষে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বড় শিলটায় বাটতে থাকেন। চারপাশটা ভরে উঠতে থাকে এক বুনো গন্ধে। অনেকদিন পর খুলনার কলাপোতা যেন হাতছানি দেয় তাঁকে। ইন্দুবালাকে ডাকে বোসপুকুরের পাশে বাঁশ ঝাড় পেরিয়ে কচু বোন। শীতের অবেলার বৃষ্টি। মাথায় দুটো বড় কচুপাতা নিয়ে দুই ভাইবোন কচু তুলতে যায়। গা হাত পা চুলকোয়। মা বকে। ঠাম্মার কাঁদো কাঁদো মুখটা আজও কেমন যেন মনে পড়ে যায় ইন্দুবালার। জ্বরের পরে স্বাদহীন মুখে খেতে চেয়েছিলেন কচুবাটা। মাকে বলেননি। জানেন এই বাদলায় কিছুতেই তিনি ইন্দুবালাকে পাঠাবেন না। ইন্দুবালাকে ডেকে বলেছিলেন “নিয়ে আসবি নাকি ইন্দু? বোসেদের বাগান থেকে একটা কচু তুলে?” ইন্দু না বলতে পারেনি। ভূতের ভয় ছিল তার। তাই ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু ইন্দু চিনবে কী করে ভালো মানকচু? সেসব তো অনেক দিন আগেই ঠাম্মা নিজে হাতে করে শিখিয়েছে। “চারপাশ থেকে ছড়ার মতো পাতা যার বেরিয়েছে। ফুলের মতো হয়ে আছে গাছ। সে জানবি গর্ভবতী। মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছে সন্তানকে। তার মধ্যে টইটম্বুর দুধ। গোড়ায় ডেউ পিঁপড়ে গুলোকে দেখেছিস? লোভীর মতো কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে?” ঠাম্মা বড় শাবল নিয়ে এসেছিলেন। ভিজে মাটিতে তাড়াতাড়ি বসে যাচ্ছিল শাবল। উঠে আসছিল ঘন কৃষ্ণকায় মাটি। গর্ত যত গভীর হচ্ছিল দেখা যাচ্ছিল শিকড়টাকে। যেখানে লুকিয়ে রেখেছে তার খাবার। একটু পরেই মাটি খুড়ে গর্ত করে কচু বের করা হল। গায়ে শক্তি ছিল বুড়ির। সেই কচু কেটে বেটে গাঁ সুদ্ধু লোক খেলো। আর আজ ঠাম্মার জ্বর। তাকে মা একটু কচু বেটে দিতে পারছে না? ভাইটা পাশে দাঁড়িয়ে খালি গা চুলকোচ্ছে। কচুর রস লেগে লাল হয়ে গেছে তার হাত পা। চুলকোতে চুলকোতে ফুলে গেছে হাতের ওপর দিকটা। তার সাথে মা গাঁ মাথায় করছে চিল চিৎকার করে। “বুড়ির মরার সময় এলো নোলা গেল না”। ইন্দুবালা চুপি চুপি রান্না ঘরে ঢোকে। পিঁড়ি পেতে বসে। কচু কেটে, কুরে, বাটতে বসে। কচুর ওপর ছড়িয়ে দেয় কাঁচা তেল। অনেক দিন পর দুপুর বেলা ধোঁওয়া ওঠা ভাতে কচু বাটা খেতে বসে ঠাম্মার চোখে জল। সেটা কাঁচা লঙ্কা সর্ষের তেলের? নাকি আনন্দের বুঝতে পারে না ইন্দুবালা। খাওয়া হয়ে গেলে এক পরিতৃপ্তির মুখ নিয়ে জড়িয়ে ধরেন ইন্দুবালাকে। তার হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে কিসব বিড়বিড় করে বলেন। আশীর্বাদ করে্ন। ঠাম্মা কি জানতো একদিন ইন্দুবালাকে এই হাত দুটোই বাঁচিয়ে দেবে? তারই কি ডাল সাঁতলানোর প্রস্তুতি সেরে রাখছিল ঠাম্মা?"
Comments
Post a Comment