বাঙালি মধ্যবিত্তের ধর্মটর্ম। আলাপ বিলাপ। স্বপ্নময় চক্রবর্তী

 হিন্দুত্ব বলতে কী বুঝি ঠিক করে বলতে পারব না। এখনকার হিন্দুরা বৈদান্তিক নয়, মায়াবাদী নয়, দ্বৈত্ব অথবা অদ্বৈত্ববাদী কোনোটাই নয়, নাস্তিকও নয়, আবার খুব ধর্মভীরুও নয়। হিন্দুদের লিখিত কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। একসঙ্গে লেখা আচার-পদ্ধতি নেই। কী কী করণীয় এবং করণীয় নয়, এই নিয়ে স্মৃতিশাস্ত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু নানা স্মৃতিকার নানারকম বিধান দিয়েছেন। মনু একরকম, বৃহস্পতি একরকম, আবার আমাদের জীমূতবাহন অন্যরকম। বাংলার রঘুনন্দন তো ব্রাহ্মণদের মৎস্যভোজনও অনুমোদিত করে দিয়েছেন। না করে উপায় ছিল না। দেশ জুড়ে এত জল, এত মাছ, মিথিলা এবং কনৌজ থেকে আমদানি করা নিরামিশাষী বামুনেরা লোভ সামলাতে না পেরে গোপনে মাছ খাচ্ছিল। ব্যাপারটা আর গোপন রইলো না। শেষকালে মৎস্যভোজনও অবিধেয় নয়, এরকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হলো। কারা কারা শূদ্র শ্রেণীতে পড়বে, সেটাও বাংলায় আলাদা। কার ক-দিন অশৌচ, সেইসব বিধানও পালটেছে। সুবর্ণ বণিকদের রাতারাতি শূদ্র করে দেওয়া হলো। কুলীনপ্রথা তৈরী হলো-- এসব বাংলার নিজস্ব ব্যাপার।

বাংলার ব্রাহ্মণরা এসেছে অনেক পরে। বাংলার আগে কৌম রাষ্ট্র ছিল। সুহ্ম, পৌণ্ড্র, সমতট, রাঢ়--এইসব নাম ছিল। পাল রাজাদের আগে বোধহয় ঠিকঠাক রাজতন্ত্র ছিল না। তখন থেকেই ব্রাহ্মণ আমদানি হতে থাকলো উত্তর ভারত থেকে। সেন আমলে আরও বেশি করে। ঠিকঠাক ব্রাহ্মণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই সেন রাজারা হেরে গেলেন। মুসলিম রাজত্ব শুরু হলো। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিবর্তন চলতে থাকলো ক্রমশ সমন্বয় সাধনের মধ্যে দিয়ে। লৌকিক দেবদেবীদের ব্রাহ্মণীকরণ হতে থাকলো। শীতলা, মনসা, ঘেঁটু-- এরা সব জাতে উঠলেন। ক্রমশ সত্যপীর সত্যনারায়ণ হলেন। ওলাইচণ্ডী, মঙ্গলচণ্ডী এদেরও বেশ রমরমা হলো। কিছু পুরোনো দেবদেবী কৌলিন্য হারালেন। দেবাদিদেব ব্রহ্মার কোনো পুজো নেই বাঙালিদের মধ্যে। অগ্নিও পাত্তাহীন হয়ে গেলেন। বরুণ-ইন্দ্র এসব বৈদিক দেবতা তুচ্ছ হয়ে গেলেন। কালী এলেন বেশ জাঁকিয়ে। যোদ্ধা কার্তিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে হয়ে গেলেন গোঁফ-ছাটা বাবরি চুলওয়ালা বাবু কার্তিক। বিদ্যাসাগর-হেয়ার সাহেব-বেথুন সাহেবের পরবর্তীকালে সরস্বতী পেলেন আলাদা গুরুত্ব। দেবী দুর্গা প্রকট হলেন হই-হই দেবী রূপে। বাঙালির ঠাকুরের আসনে ২৫/৩০ বছর আগে হঠাৎ আবির্ভাব ঘটলো সন্তোষী মায়ের। ট্যুরিজমের কল্যাণে বাঙালি ঠাকুরঘরের দেয়ালে ঝুললো বেঙ্কটেশ্বরের চোখ বাঁধা ছবি, কিংবা বৈষ্ণোদেবী মাতাদি। বুদ্ধদেব অনেক আগেই বিষ্ণুর অবতার হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক বাড়িতে বুদ্ধদেবের ছবি আছে, যীশুর ছবিও। যীশুর ছবিতে পঁচিশে ডিসেম্বর মালা পড়ানো হয়। হজরত মহম্মদের কোনো ছবি নেই, থাকলে হয়তো প্রগতিশীল হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে অর্চিত হতেন। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার, বাঙালি হনুমানকে ঠিকভাবে নিল না। বাঙালি ঠাকুরঘরে হনুমানের অভাব।

বাঙালি মধ্যবিত্তের ধর্মবোধ বেশ জটিল। কিছুতেই ঠিকমতো বিশ্বাস নেই, আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও নেই। এ ছাড়া মধ্যবিত্তরা মিশিয়ে নিয়েছেন অনেক কিছু। কেক-দোসা-ইডলি-প্যাঁড়া-উপমা-চাউ-- সবই বাঙালি মধ্যবিত্ত নিজেদের করে নিয়েছে, নিজেদের মতো করে। বাঙালি চাউমিনে হলুদ দিচ্ছে, দোসার মশলায় ধনেপাতা দিচ্ছে, তেমনি করেই বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দুরা-- বৈষ্ণব, তান্ত্রিকতা, শৈবমত, লোকায়ত বিশ্বাস সবই মিলিয়ে মিশিয়ে নিয়েছে, এমনকি কিছুটা খ্রিশ্চিয়ানিটি। চিনা ফেংসুই এখন বাঙালির নিজের।

বাঙালি মধ্যবিত্তের ধর্মবিশ্বাসকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ক. যারা পুরোপুরি নাস্তিক....খ. ঈশ্বরের ব্যাপারে একটা প্রশ্নচিহ্ন আছে... গ. ঈশ্বর, আত্মা, অলৌকিক ব্যাপার, পাথর, তাবিজ-মাদুলি---সবকিছুতেই বিশ্বাস আছে। ঘ. কিছুতেই পুরোপুরি বিশ্বাস নেই, আবার অবিশ্বাসও নেই। ঙ. ঈশ্বর-টিশ্বর নিয়ে অত ভাবনা-চিন্তার সময় নেই। গুরুদেব যা বলেছেন, সেটাই ঠিক। গুরুদেব নির্বাচনের ব্যাপারেও মধ্যবিত্তদের মধ্যে শ্রণীভেদ আছে। যাঁরা শ্রীশ্রীমা মানে অরবিন্দ আশ্রমের শিষ্য, তাঁরা হলেন সবচেয়ে এলিট। এরপরই রামকৃষ্ণ মিশন। শ্রীশ্রীওঁকারনাথ, মোহনানন্দ এরপর। শ্রীশ্রীঅনুকূলঠাকুর এবং শ্রীশ্রীস্বরূপানন্দ ঠাকুরের শিষ্যরাও আছেন। শ্রীশ্রীবালক ব্রহ্মচারীর শিষ্যরা আবার আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে খানিকটা বীর রস মিশিয়েছন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বললেন, ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ। আবার রবীন্দ্রনাথের 'চতুরঙ্গ' উপন্যাসের জগমোহন যুক্তি সাজাচ্ছেন-- ঈশ্বর যদি থাকেন, তবে আমার এই বুদ্ধি ঈশ্বরের দান।
সেই বুদ্ধি বলিতেছে যে, ঈশ্বর নাই..।


'বাঙালি মধ্যবিত্তের ধর্মটর্ম' থেকে।
আলাপ বিলাপ
স্বপ্নময় চক্রবর্তী

#সুপ্রকাশ


অনলাইন অর্ডার লিঙ্কঃ https://thinkerslane.com/?product=alap-bilap

বাংলাদেশে বইটি পেতে সুপ্রকাশের নাম করে নোকতা(বুবুক), তক্ষশিলা বা বাতিঘরে সুপ্রকাশে নাম করে অর্ডার দিতে পারেন।


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।