সীমান্ত। পঞ্চাশটি গল্প। অভিজিৎ সেন

 বাসের ভিড় কমতে ভাদ্রমাসের গুমোটটাও কম লাগলো বিভূতির। অল্প কয়েকজন লোক আছে বাসে, এমনকি কতগুলো বসার আসন খালিই পড়ে রয়েছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মধ্যবয়সী এক দম্পতি গাড়ির মেঝেতে বসে আছে একপাশে। ভূপতি বলে, 'সিটে উঠে বসুন, জায়গা তো আছে।'
তারা ওঠে না।'
কনডাক্টর এসে তাদের সামনের আসনটায় বসে। বলে, 'মিঁয়া বিবি দোনো জনায়ই বিনি পয়সায় যাবা ? ক্যান ? আমি তা হবার দিমো ক্যান ? পয়সা বার কর।'
লোকটি একটু করুণ হাসি হাসার চেষ্টা করে বলে, 'থাকলে দিই না ? পয়সা নাই।'
'পয়সা নাই, গাড়িৎ ওঠার শখ ক্যান ? পয়সা নাই, হাঁইটে যাও।'
'শখ নয় বাবু, দরকারে আসিছিলাম। এত দূর রাস্তা--'
'দেখি বিবির বোঁচকা খোল, পয়সা আছে কি না দেখমো।'
নোংরা এবং ছেঁড়া ঘোমটার আড়ালে স্ত্রীলোকটির মুখ দেখা যায় না। কনটাক্টার টান দিয়ে বোঁচকা নেয় এবং খুলে ফেলে, ছড়ায়।বস্তুত তার হাবেভাবে এটা পরিষ্কার যে, সে পয়সার জন্য যতটা না উৎসাহী তার থেকে অনেক বেশি উৎসাহী রগড় করতে বা অন্য মানসিকতায়।
'যাবা কুনঠি ? ওপারে ?'
লোকটি মাথা নাড়ায়।
'পাশফোট আছে ?'
লোকটি করুণ দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকায়। আরও দু-চারজন মানুষ রগড়ের গন্ধ পেয়েছে। একজন বলে, 'আরে পয়সা নাই তো পিরানটা খুইলে ল্যান।'
লোকটি বক্তার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয়।
এক যুবক উগ্র হয়। বলে, 'নামায়ে দ্যান গাড়ি থিক্যা। শালা বেইমানের জাত। এপাড়েৎ শালারা যেথা খুশি সেথা ঘুরে বেড়ায়, হাঁরা কিছু কই না। আর ওপারেৎ যান-- শালার মিৎচ্যাংড়া ছোলগুলা পর্যন্ত পিছু নাগবে--- "কুনঠি যাবেন", "বাড়ি কোথায়" --- নামো শালা।'
বিভূতি লোকটির কাঁধে হাত দেয়। চোখ ফিরিয়ে লোকটি বিভূতির চোখে চোখ রাখে।
বিভূতি বলে, 'সিটে উঠে বসুন।'
লোকটি বিভূতির পাশে সন্তর্পণে বসে।
'কোথায় যাবেন ?'
শেষ পর্যন্ত যাবেন তাঁরা।

পকেট থেকে টাকা বের করে কন্ডাক্টরের দিকে বাড়িয়ে দেয় বিভূতি। বলে, এদের টিকিট দুটো দিন। সে বাঁ হাত দিয়ে টাকাটা বাড়িয়ে দেয় এবং কন্ডাক্টরের মুখের দিকে তাকায় না। কন্ডাক্টর টিকিট দেয়। সেই উগ্র যুবকের সমর্থনেও লোক পাওয়া যায়। 'জয়বাংলা' অর্থাৎ বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় এই নিমকহারাম মানুষগুলোর জন্য কে কী করেছে, তার একটা হিসাবও হয়। ছোকরা বিভূতিকে শুনিয়ে শ্লেষ করে, 'মুসুলমানের সঙ্গে পিরিত, হুঁ।'

বিভূতি অন্যদের কথা শোনে না, কিন্ত খোকা শোনে এবং এক একটা মন্তব্যে হঠাৎ হঠাৎ চোখ তুলে বাপের দিকে তাকায়।
বিভূতি বলে, 'আপনারা কি ওপারে যাবেন ?'
লোকটি বলে, 'হ্যাঁ, বাবু।'
বিভূতি বলে, 'পাসপোর্ট আছে ?'
'না।'
'তাহলে যাবেন কী করে ?'
'কত লোক তো যাতায়াত করে। আজ খুব একটা অসুবিধা হোবে না।'
'কেন ?'
'আজ না খুশির ঈদ ?'

.................................................................................................
তারা চলে যেতে বিভূতি চা নিয়ে আর কিছু সময় বসে থাকে। তারপর খোকাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে চেকপোস্টে আসে।
দূরের থেকে চেকপোস্টের ভিড় দেখে তারা, লোকজনের গুঞ্জন শোনে। দু-পাঁচশো মানুষ ভারত-বাংলাদেশ সীমানর চিহ্ন মুছে দিয়ে ভারী সমারোহ শুরু করেছে সেখানে। সে এক বিচিত্র দৃশ্য। বসে, দাঁড়িয়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মানুষ। অনেকদিন পরে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হয়েছে সব। একসঙ্গে খাবার-দাবার খাচ্ছে কোথাও গোল হয়ে বসে, কোথাও সরব সহর্ষ গল্প গুজব, কোথাও জড়াজড়ি করে কান্নাকাটি। মেলার মেজাজে মণিহারি এবং মিষ্টির দোকান বেশ কয়েকটি। খাকি ইউনিফর্ম, কাঁধে ঝোলানো সাব-মেশিনগান নিয়ে সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সৈনিকরা যে নেই, এমন নয়। তবে আজ যেন তারাও খুব নিস্পৃহ।
বিভূতি অবাক হয়। ভাবতে থাকে, ব্যাপারটা কী ? সমস্ত চত্বরটা এমন স্বাভাবিক যে, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও তার সংকোচ হচ্ছে।
সে আবার একটা চায়ের দোকানে বসে। একটা সিগারেট ধরিয়ে দোকানিকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে, 'আজ এখানে এত ভিড় কেন ভাই ? দোকানি বলে, আজ ঈদ না ? ওপারের মানুষ এপারের মানুষ সব এখানে এসে কান্নাকাটি করবে সারাদিন।'
'এখানে অনেক হিন্দুও তো আছে।'
'আছে তো।'
'প্রতি বছর এমন হয় ?'
'হ্যাঁ, দুবার করে হয় বছরে। এই ঈদের সময় একবার, ফের বিজয়া দশমীর সময় একবার।'
'বি এস এফ, কাস্টমস, এরা বাধা দেয় না ?'
'মানুষের মেলামেশায় কি কেউ বাধা দিতে পারে দাদা !'

বিভূতি খোকাকে নিয়ে বসে থাকে। একসময় খোকাকে সে জিজ্ঞেস করে, 'খোকা এর মধ্যে কোন লোকটা হিন্দু, কোন লোকটা মুসলমান খুঁজে বের করতে পারবি ?'
খোকা ভিড়ের ভিতর চোখ ঘোরায়।
বিভূতি মনে মনে প্রার্থনার মতো স্তব করতে থাকে, 'পারিস না খোকা-- পারিস না।'

'সীমান্ত'-থেকে।
অভিজিৎ সেনের পঞ্চাশটি গল্প

#সুপ্রকাশ

অনলাইন অর্ডার লিঙ্কঃ https://thinkerslane.com/?product=panchashti-galpa-abhijit-sen

বাংলাদেশে বইটি পেতে সুপ্রকাশের নাম করে নোকতা(বুবুক), তক্ষশিলা বা বাতিঘরে সুপ্রকাশে নাম করে অর্ডার দিতে পারেন।



Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।