প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের উপন্যাস 'প্রতিযাত্রা' পড়ে মতামত জানিয়েছেন ফারজানা রহমান। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
................................................................................................
বই : প্রতিযাত্রা
লেখক : দুর্লভ সূত্রধর
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ টাকা
 
বিনয় মুখোপাধ্যায় (যাযাবর) তার দৃষ্টিপাত বইয়ে লিখেছিলেন, "ডিসেম্বরের সাঁইত্রিশ ডিগ্রির শীতে গালে ঠান্ডা জল দেবার চাইতে চড় দেয়া ভালো"। দুর্লভ সূত্রধরের "আহাম্মকের খুদকুড়ো" এবং "অনন্যবর্তী" এর ম্যাজিকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যখনই "প্রতিযাত্রা" ধরবেন, তখনই অনুভব করবেন সেই ঠান্ডা চড়! দুর্লভ সুত্রধর তার "প্রতিযাত্রা" দিয়ে শুরুতেই পাঠককে একটা পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেন।

প্রতিযাত্রার সবচেয়ে উজ্জ্বল চিহ্ন তার ভাষার স্বকীয়তা। পাঠক তা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন; অনুভব করবেন। এহেন ভাষার স্বকীয়তা এবং পাশাপাশি উপমা-রূপকে সজ্জিত মায়াজাল পাঠককে চাবুকের মতো আঘাত করবে। কারন পূর্ববর্তী দুটো বই পাঠ শেষে খুব স্বাভাবিকভাবেই পাঠক একটু আয়েশি-ভঙ্গিমায় প্রতিযাত্রা শুরু করতেই পারেন। কিন্তু এই বই পাঠককে যেমন ফেলে দেয় পরীক্ষার মাঝে, তেমনি অসম্ভব বাড়তি মনোযোগের দাবিদার। এ এক নতুন "দুর্লভ সূত্রধর"। ধ্রুপদ পর্যায়ের এসেন্সে নিয়ে এই বই এক নতুন যাত্রা।

বুদ্ধশাসনের মহিমা রক্ষার দায় নিয়ে আচার্য মহাকনককাঞ্চন যে পরিব্রাজনে বহির্গত হয়েছেন এবং যে সময়কালের কথা বর্ণিত হয়েছে তার অবয়বে মানানসই (পাঠকের জন্যে হয়তো না) পোষাক (ভাষা/শব্দ) প্রয়োগে লেখক বেঁছে নিয়েছেন পালি ভাষা এবং শব্দ। ত্রিপিটক এর সাহিত্য ভাষা হওয়ার কারনে হয়তো "প্রতিযাত্রায়" সেই সময়কার বিমূর্ততা ফুঁটে উঠেছে, পাশাপাশি পাঠকও নিঃসন্দেহে বিমূঢ় হয়ে থাকবেন।

পাঠের শুরুতে বারবার অন্তর্জালে শব্দে অর্থ খুঁজতে যাওয়া এবং না পাওয়ার হতাশা পড়ার গতিকে শ্লথ করেছে। তবে কিছু দূর যাবার পরে টের পাই, বইয়ের শেষে "শব্দসন্ধির" (শব্দার্থ) সংযুক্তি। সেখান থেকে পাঠটুকু অপেক্ষাকৃত সহজতর হয়ে উঠেছে। এবং পর্যায়ক্রমে অন্ধকার সয়ে যাবার মতো অচেনা শব্দগুলোও ধীরে ধীরে অনেকটা বোধগম্য ও পরিচিত হয়ে ধরা দেয়।

যদিও এরূপ ভাষার ব্যবহার এবং বুদ্ধদর্শনের একটানা বয়ান কিছুটা মনোটোনাস হয়ে ওঠে বৈকি, তবে ঠিক তখনই "জুঁই ফুলের ঘ্রাণ" পাঠককে আলাদা সুবাস দিয়ে যায়। সুধীরা এবং আবীরা ও সুপণ্যক-অভিদীপ্তের ঘটনাপ্রবাহ সেই মনোটোনাস ফীল থেকে কিছটা মুক্তি দেয়।

"প্রতিযাত্রার" কাহিনির ব্যপ্তি যে খুব বৃহৎ তা নয়, বরং দুর্লভ সূত্রধরের অন্য বইয়ের মতোই সাধারন একটা কাহিনি ধীরে ধীরে অসম্ভব কোন নাটকীয়তা ছাড়াই খুব সাধারন দিকে মোড় নেয়। শুধু এই জায়গায় এসে হয়তো আমরা কিছুটা পূর্বের দুর্লভ সূত্রধরকে খুঁজে পাই। এটুকু ছাড়া লেখক নিজেকে নিয়ে গেছেন যেমন অন্য উচ্চতায়, তেমনি শুরুতেই বলেছি পাঠককে এক সময়সাপেক্ষ এবং ধৈয্যসাপেক্ষ পরীক্ষায় অবতীর্ন হতেই হবে। আগ্রহী হলে এটুকু বলে রাখা শ্রেয় যে, শুরুর  ১/২ প্যারা বা ১ পাতা পড়ে নিয়েই সেই সিদ্ধান্ত নেয়া্ উপকারী বলে গন্য হবে।

দূর্লভ সূত্রধরের "প্রতিযাত্রা" নিয়ে খুব দারুন সময় গিয়েছে বলার উপায় নেই। তবে এই নতুন দুর্লভ সূত্রধরকে আবিস্কারের বিস্ময়টুকু এই সময়ে এসে উপভোগ করেছি। সাথে নিজের ধের্য্যটুকুও একটু বাঁধিয়ে নিয়েছি প্রতিযাত্রার ভাষা ও শব্দের স্বকীয়তায়!

দর্শন যদি হয় পাঠকের তৃষ্ণা ও জানার ধর্ম, তবে দুর্লভ সূত্রধরের "প্রতিযাত্রা"র প্রতি প্রতিযাত্রা মোক্ষম অবশ্যই।



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।